মবিনুর রহমানের হাতে পানির গ্লাস। তিনি কিছুক্ষণ পরপর বরফ শীতল পানিতে চুমুক দিচ্ছেন, শ্বাসকষ্ট তখন কিছু কম হচ্ছে। এই বিষয়টা ডাক্তারকে বলতে হবে।
শফিক তাঁর সামনে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে চিন্তিতবোধ করছে। কি নিয়ে চিন্তা করছে জানতে পারলে ভাল হতো। ভবিষ্যতে মানুষ এমন কোনো যন্ত্র কি বের করতে পারবে যা দিয়ে মনের কথা বুঝা যায়? যত টাকাই লাগুক এ রকম একটা যন্ত্র তিনি কিনতেন। যন্ত্র কানে লাগিয়ে বসে থাকতেন। তার সামনে লোকজন আসত-যেত। তিনি কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলতেন না।
শফিক।
জি স্যার।
এখন বলো লায়লা তোমাকে কি জন্যে ডেকেছিলো।
তিনি আমার বাবার জন্যে কিছু খাবার দিয়ে দিলেন।
কী খাবার?
শিং মাছের ডিম। ঐদিন বাবা কথায় কথায় বলেছিলেন তাঁর সবচে পছন্দের খাবার শিং মাছের ডিম। অনেক দিন তিনি এটা খান না। মাঝে মধ্যে খুব খেতে ইচ্ছা করে।
লায়লা কি বলেছিল যে সে শিং মাছের ডিম রান্না করে খাওয়াবে?
জি না স্যার বলেননি।
সে শিং মাছের ডিম রান্না করে পাঠিয়ে দিল কেন? সে কেন বলল না তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে এসে পছন্দের খাবার খেয়ে যাও।
জানি না স্যার।
কারণটা তো খুব সহজ তুমি জানো না কেন?
স্যার কারণটা সহজ হলেও আমি ধরতে পারছি না। আমার বুদ্ধি কম।
কারণটা তোমাকে বলি– তোমার বাবাকে সে যদি দাওয়াত করে শিং মাছের ডিম খাওয়াতে তাহলে ব্যাপারটা হতে অনেক আইটেমে একটা পছন্দের আইটেম। আর এখন কি হল—– শিং মাছের ডিমটা অনেক বেশি গুরুত্ব পেল। জিনিসটা রান্না হলো নারায়ণগঞ্জ। একজন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে জিনিসটা সগ্রহ করে আবার ঢাকায় ফিরে গেল।
স্যার ম্যাডাম হয়তো এত চিন্তা করে কিছু করেননি।
বাবুল শোনো মানুষ আলাদাভাবে গালে হাত দিয়ে চিন্তাভাবনা করে কিছু বের করে না। চিন্তার ব্যাপারটা সব সময় হতে থাকে। বেশির ভাগ সময় মানুষ এটা বুঝতে পারে না। এখন বলো তোমার পছন্দের খাবার কী?
আমার আলাদাভাবে তেমন পছন্দের কোনো খাবার নেই।
কয়টা বাজে?
স্যার এগারোটা বাজে।
আচ্ছা তুমি যাও।
শফিক ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা খেল। ধড়াম করে শব্দ হলো। স্বাভাবিক রিফ্লেক্স একশানে মানুষ শব্দের দিকে ফিরে তাকাবে। মবিনুর রহমান ফিরে তাকালেন না। মূর্তির মতো বসে রইলেন।
শফিকের মা মনোয়ারা বেগম
শফিকের মা মনোয়ারা বেগম বাথরুমে পা পিছলে পড়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছেন। আঘাত তেমন গুরুতর না। মাথা ফাটেনি। তবু তিনি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেললেন। তাঁর বড় মেয়ে সুরমা এবং মেয়ের জামাই ফরিদ দৌড়ে এসে তাকে তুলতে গেল। তিনি মেয়ে জামাই-এর দিকে তাকিয়ে, তুমি গায়ে হাত দিচ্ছ কেন? তুমি দূরে থাক।
ফরিদ বলল, মা আপনাকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেই?
তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, শাশুড়ির গায়ে হাত দিবে এটা কেমন কথা!
আপনার ছেলে এখানে থাকলে সে আপনাকে ধরত না?
মনোয়ারা বললেন, মুখে মুখে তর্ক করবে না। ছেলে আর মেয়ের জামাই এক। তর্ক করা হয়েছে তোমার স্বভাব।
আপনি বাথরুমে পড়ে থাকবেন?
হ্যাঁ বাথরুমে পড়ে থাকব তুমি সামনে থেকে যাও।
সুরমা মাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। মনোয়ারার পর্বতের মতো দেহ নড়ানোর সাধ্য তার নেই। মনোয়ারা মেয়েকেও ধমক দিলেন–ঢং করিস না। বিয়ে হয়েছে, ছেলে-মেয়ে হয়েছে এখন ঢং ছাড়তে পারলি না?
সুরমা বলল, ঢং কী করলাম?
হাত ধরে দড়ি টানাটানি খেলা খেলছিস, এর নাম ঢং। আমি দড়ি না।
মুখের কাছে কমোড় নিয়ে বাথরুমে পড়ে থাকবে?
হ্যাঁ থাকব। তুই যা তোর জামাইকে কফি বানিয়ে খাওয়া। বাজার থেকে পেস্ট্রি এনে দুই জনে মিলে কেক-পেস্ট্রি খা।
কেক-পেস্ট্রির ছোট্ট ইতিহাস আছে। গতকাল সন্ধ্যায় ফরিদের কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছিল। তাদের জন্যে কেক-পেস্ট্রি আনা হয়েছে। মনোয়ারাকে দেয়া হয়নি কারণ তাঁর ডায়াবেটিস ভয়াবহ পর্যায়ের। মনোয়ারা ব্যাপারটা মনে রেখেছেন। তিনি সহজে কিছু ভুলেন না।
সুরমা বলল, মা একটু চেষ্টা করে দেখ না নিজে নিজে উঠতে পার কিনা।
মনোয়ারা বললেন, উঠতে পারলে তো উঠেই যেতাম। মুখের কাছে গু নিয়ে শুয়ে থাকতাম না। তোর ইংরেজির মহাসাগর বাপকে খবর দে। সে এসে দেখুক কি অবস্থা। শফিককে খবর দে। মনে হয় না আমি বাঁচব।
তোমার কিছু হয়নি মা।
আমার কিছু হয় নাই, টং করার জন্যে বাথরুমে শুয়ে আছি? সামনে থেকে যা। তোর চেহারা যেমন বান্দরের মতো কথাবার্তাও বান্দরের মতো কিচকিচ কিচকিচ। গলার আওয়াজ শুনলেই মাথা ধরে।
ঘটনা ঘটেছে দুপুরে এখন প্রায় সন্ধ্যা এখনো মনোয়ারা বাথরুমেই শুয়ে আছেন। ডাক্তার এসে দেখেছেন? বলে গেছেন মাথার সিটিস্ক্যান করালে ভাল হয়। সিটিস্ক্যান মেশিন ঢাকায় নতুন এসেছে। ডাক্তাররা এখন কথায় কথায় সিটিস্ক্যান করাতে বলেন।
এম্বুলেন্স খবর দেয়া হয়েছে। এখনো এসে পৌঁছায়নি। এম্বুলেন্সের লোকজন স্ট্রেচারে করে তাকে বাথরুম থেকে নিয়ে যাবে। সুরমার মনে ক্ষীণ আশা মা তাতে আপত্তি করবে না।
জয়নাল সাহেব খবর পেয়ে চলে এসেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার মতো মানসিক সাহস তিনি এখনো সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি। যতবারই মনোয়ারার সঙ্গে দেখা হয়েছে ততবারই তাকে ভয়াবহ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। মাঝে মাঝে তার কাছে মনে হয় এই যে তিনি একা হোটেলে বাস করেন তার পিছনে আল্লাহপাকের খাস রহমত আছে। আল্লাহপাক সব কিছুই বিবেচনা করে এই ব্যবস্থা করেছেন।