মবিনুর রহমানের মুখ হাসিহাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মজা পাচ্ছেন। তিনি ডিকশনারি হাতে বসে থাকা লোকটার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন, এখন আমি কি বলব একটু মন দিয়ে শুনবেন।
জয়নাল সাহেব ভীত গলায় বললেন, আপনার সব কথাই আমি মন দিয়ে শুনছি জনাব।
চার বছর বয়েসী বাচ্চার মনে কোনো স্মৃতি থাকে না; কিন্তু আমার বাবাকে নিয়ে কিছু স্মৃতি আছে। তার মধ্যে একটা হলো আমার বাবা আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন। ঘাড়ে ধরে পুকুরের পানিতে মাথা ড়ুবিয়ে রাখছেন। আমার নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে। এখন আপনি বলুন এই মানুষটাকে খুন করার ইচ্ছা হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক কিছু?
জয়নাল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, জনাব খুবই পানির পিপাসা হয়েছে। এক গ্লাস পানি খাব।
বরফ দেয়া ঠাণ্ডা পানি?
জি জনাব বরফ দেয়া ঠাণ্ডা পানি।
জয়নাল সাহেবকে বিস্মিত করে দিয়ে এই মানুষটা নিজেই হাতে করে পানি নিয়ে এলেন। কোটিপতি একজন মানুষ। একের পর সাতটা শূন্য বসালে কোটি হয়। কোটির পরে কি আছে? বিলিয়নের পরে আছে ট্রিলিয়ন। কোটির পরে কি?
জয়নাল সাহেব।
জি।
আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
সামান্য লাগছে। যদি ইজাজত দেন আমি হোটেলে চলে যাই।
ডিনার করবেন না?
জি না। শরীরটা ভালো না।
আচ্ছা ঠিক আছে যান। গাড়ি আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। আরেক দিন আপনাকে খবর দিয়ে অনিব।
আপনি যখন বলবেন চলে আসব।
আপনাকে সঙ্গে নিয়ে একটা দৃশ্য দেখব। তিন-চার বছর বয়েসী একটা বাচ্চা জোগাড় করব। বাচ্চার বাবাকে দিয়ে বাচ্চাটাকে শাস্তি দেয়াব। বাচ্চার বাবা সামান্য কিছু সময়ের জন্যে বাচ্চাকে ঘাড়ে ধরে চৌবাচ্চার পানিতে চুবিয়ে রাখবে। ইন্টারেস্টিং হবে না?
জয়নাল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, জি জনাব।
আপনার সন্ধানে কি এই বয়সের কোনো ছেলে বা মেয়ে আছে?
জয়নাল সাহেব আবারো বিড়বিড় করলেন। কি বললেন কিছুই বুঝা গেল না।
মঞ্জু মামা চেয়ারে পা তুলে
মঞ্জু মামা চেয়ারে পা তুলে আয়েশ করে বসে আছেন। তিনি সহজে যাবেন মীরার এ রকম মনে হচ্ছে না। সে শংকিত বোধ করছে। রাত আটটা বাজে, যে কোন সময় শফিক এসে উপস্থিত হবে। মঞ্জু মামাকে দেখে সে আহ্লাদিত বোধ করবে এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। অথচ একটা সময় ছিল যখন শফিক তাকে পাঠাত মঞ্জু মামার কাছে। টাকা ধার করে আনতে। তখন কি শফিক জানতো না প্রৌঢ় চিরকুমারদের সাধারণ যেসব ত্রুটি থাকে এই মানুষটির সেসব ত্রুটি আছে। ভালমতোই আছে। টাকা দেবার সময় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করা কিংবা হঠাৎ গালে হাত দিয়ে বলা তোর গালে এটা কি? ব্রণ না-কি?
কি সেন্ট মেখেছিসরে? সুন্দর গন্ধ তো বলে নাক বুকের কাছাকাছি নিয়ে আসা। মানুষটার সাহস কম বলে মীরা অল্পতে পার পেয়েছে। শফিক এইসব কিছুই জানে না। তারপরেও কিছু নিশ্চয়ই অনুমান করে।
মঞ্জু পান চিবুচ্ছেন। পানের রস ঠোঁট বেয়ে নিচে নামছে। তিনি ঝোল টানার মতো পানের রস টানছেন। এই কাজটা করতে গিয়ে আনন্দ পাচ্ছেন বলেও মনে হচ্ছে। এক্ষুণি মানুষটাকে চলে যেতে বলা উচিত। ভদ্রভাবে এই কাজটা সে কিভাবে করবে ভেবে পাচ্ছে না। মীরা বলল, মামা তুমি আমাদের কাছে কত টাকা পাও বল তো?
মঞ্জু হাঁটু দুলাতে দুলাতে বললেন, কেন টাকাটা দিয়ে দিবি?
দেব। নিশোর বাবা ঋণ শোধ করা শুরু করেছে।
তোর কি ধারণা তোর কাছে টাকা ফেরত নিতে এসেছি?
সে রকম ধারণা না। জানার জন্যে বললাম। একসঙ্গে সব টাকা দিতে পারব না। ভাগ ভাগ করে দিতে হবে।
তোদর মনে হয় অনেক টাকা হয়েছে।
মামা ও বেতন ভাল পাচ্ছে।
ভাল মানে কী? কত টাকা বেতন?
মীরা বলল, মাসে বিশ হাজার করে পাচ্ছে।
মীরা একটু বাড়িয়ে বলল। বেতন আসলে পনেরো হাজার। বিশ হাজার বলে তার ভাল লাগছে। এতই ভাল লাগছে যে চোখ ভিজে আমার মতো হয়ে যাচ্ছে। মঞ্জুর চোখে একটু যেন সন্দেহের ছায়া, বিশ হাজার টাকা বেতন? বলিস কি?
অফিস থেকে তাকে একটা গাড়িও দিয়েছে। ফুলটাইম গাড়ি। আমাদের তো গ্যারেজ নেই। গাড়ি রাস্তায় থাকে। ড্রাইভার গাড়িতে ঘুমায়।
সত্যি বলছিস?
তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলব কেন মামা?
এখনো এক রুমের বাসায় পড়ে আছিস কেন? নতুন বাসা নে।
বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছি, পছন্দমতো পাচ্ছি না। আমাদের দরকার তিন রুমের ফ্ল্যাট। একটাতে আমরা থাকব। একটাতে শ্বশুর-শাশুড়ি থাকবেন। আরেকটা গেস্ট রুম।
গেস্ট রুমটা সুন্দর করে সাজাবি। আমি এসে মাঝে মধ্যে থাকব।
অবশ্যই থাকবে।
তুই বললে আমি বাসা খুঁজে দিতে পারি।
তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। ও কোম্পানি থেকে ফ্ল্যাট পাবে এ রকম সম্ভাবনাও আছে। ঐ সব ফ্ল্যাট খুবই ভাল। ফার্নিশও। কোনো ফার্নিচার কিনতে হবে না। টিভি, মাইক্রোওয়েভ সব আছে।
তোরা তো মনে হয় আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেছিস।
একটু দোয়া কর মামা। বিয়ের পর থেকে বেচারা অনেক কষ্ট করেছে।
প্রথম জীবনে কষ্ট করলে শেষ জীবনে আরাম হয়। এই আমাকে দেখ। কষ্টও তেমন করিনি আরামও তেমন পাইনি। সারাটা জীবন সমান সমান পার করে দিলাম। শফিক আসবে কখন? তাকে কনগ্রাচুলেশান্স দিয়ে যেতাম।
মামা ওর আসতে অনেক দেরি হবে।
অসুবিধা নেই আমি বসি। আমার কাজকর্ম তো কিছু নেই। এখানে বসে থাকাও যা নিজের বাড়িতে বসে থাকাও তা। চা বানা, এক কাপ চা খাই। রং চা। পত্রিকায় পড়েছি রং চা হার্টের জন্যে ভাল।
মীরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, চা আরেক দিন খেও মামা। আমি এখন শাশুড়িকে দেখতে যাব। শুনেছি ওনার শরীর খারাপ করেছে।