নিশো বলল, বাবা আজ পোলাও-এর সঙ্গে কী রান্না হচ্ছে বলো তো?
শফিক বলল, জানি না।
আন্দাজু করে। (আন্দাজকে নিশো আন্দাজু বলে।)
আন্দাজু করতে পারছি না।
চেষ্টা করে।
চেষ্টা করতে পারছি না। বিরক্ত কোরো না তো নিশো।
মীরা বলল, আমার রাগটা তুমি মেয়ের ওপর দেখাচ্ছ কেন? তোমার সমস্যা কী?
শফিক কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিল, বলল না। নিজেকে সামলে নিল। এখন সে চোখ বন্ধ করে এমন ভাবে মাথা নাড়ছে যেন মাথার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে। মীরা বলল, বৃষ্টির মধ্যে তুমি যখন গোসল করো তখন চা খেতে পছন্দ করো। এনে দেব এক কাপ চা?
দাও।
চা খেয়ে মেজাজ ঠাণ্ডা করো। প্লিজ।
মীরা চা আনতে গেল। নিশো বলল, বাবা এখন আন্দাজু করো পোলাও-এর সঙ্গে কী রান্না হয়েছে?
হরিণের মাংসের কাবাব। ময়ূরের রোস্ট।
হয়নি।
তাহলে মনে হয় হাতির মাংসের রেজালা, ঘোড়ার মাংসের কোরমা।
বাবা তুমি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ। ভালো হবে না বলছি। আমিও কিন্তু মার মতো রাগ করব।
শফিক হেসে ফেলল। মীরার ওপর যে রাগ তৈরি হয়েছিল এখন আর তা নেই। হেসে ফেলায় সব শেষ। এখন শফিকের ইচ্ছা করছে মীরাকে সত্যি কথাটা বলতে। সে এখন মীরাকে বলতে পারে তোমার জন্মদিনের তারিখটা আমি ভুলে গেছি এটা সত্যি তবে আমাদের অফিসের একজন কর্মচারীর হার্ট এটাকের মতো হয়েছিল এটাও সত্যি।
মীরা চা এনে দেখে বাবা-মেয়ে দুজনই খুব হাসাহাসি করছে। শফিক হতি দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে আর মেয়ে বলছে—বাবা ভালো হবে না বলছি। আমি কিন্তু খুব রাগ করছি। আমি কিন্তু ভয়ংকর রেগে যাচ্ছি।
জয়নাল সাহেব অবাক হয়ে তাঁর সামনে বসে থাকা মানুষটাকে দেখছেন। এই মানুষটা নাকি কোটিপতির ওপর কোটিপতি। তিনি তার জীবনে কোনো কোটিপতি দেখেননি। এক লক্ষ লিখতে একের পর পাঁচটা শূন্য দিতে হয়। এক কোটি লিখতে কয়টা শূন্য লাগে তিনি এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেন না। নিযুতের পর হলো কোটি। নিযুত লিখতে ছয়টা শূন্য তার মানে সাতটা শূন্য। এক বিলিয়নে কয়টা শূন্য? যাক এইসব নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে এখন বরং কোটিপতি মানুষটাকে দেখা যাক।
মানুষটা চেয়ারে দুলছেন। বেশিক্ষণ দুলুনি দেখা যায় না। মাথা ঝিমঝিম করে। মানুষটা সিগারেট খাচ্ছে। নিশ্চয়ই খুবই দামি সিগারেট। তিনি নিজে সিগারেট খান না তবে দামি একটা সিগারেট খেয়ে দেখা যেতে পারে। তবে এই মানুষের সামনে খাওয়া যাবে না। বেয়াদবি হবে।
আপনি ডিকশনারি মুখস্থ করে ফেলেছেন?
জি জনাব।
আপনি যেখানেই যান হাতে ডিকশনারি থাকে?
জি জনাব।
বাস করেন একটা হোটেলে?
জি জনাব।
আপনি কি সুখে আছেন?
জি জনাব।
রাতের খাওয়া খেয়েছেন?
জি না।
আমার সঙ্গে রাতের খাওয়া খান অসুবিধা আছে?
জি না জনাব।
প্রতিটি বাক্য জনাব দিয়ে বলছেন কেন?
আপনি নিষেধ করলে বলব না।
আপনার স্মৃতিশক্তি কেমন?
স্মৃতিশক্তি ভালো না জনাব।
ভালো না বলছেন কেন? গোটা ডিকশনারি মুখস্থ করে ফেলেছেন।
আমার স্মৃতিশক্তি ভালো না জনাব। সব ক্ষমতা ডিকশনারি মুখস্থ করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি।
নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন সেটা মনে আছে?
জি জনাব মনে আছে।
লায়লার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মনে আছে?
জি মনে আছে।
দুপুরে খেয়েছিলেন মনে আছে?
মনে আছে।
আইটেম কী কী ছিল মনে আছে?
আছে।
তাহলে তো অনেক কিছুই মনে আছে। এখন বলুন লায়লার সঙ্গে কি কি কথা হয়েছিল। কোনো কিছুই বাদ দেবেন না। আপনারা দুজন মিলে হাসাহাসিও করছিলেন বলে শুনেছি। কি নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন সেটা আগে বলুন।
জয়নাল সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছেন। তাঁর সামনে চেয়ারে বসে যে মানুষটা দোল খাচ্ছে তাকে এখন আর খুব স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মানুষটার কোনো সমস্যা আছে। বড় কোনো সমস্যা।
মবিনুর রহমান বললেন, চুপ করে আছেন কেন, বলুন।
উনি তার মেয়ের নানা কর্মকাণ্ডের কথা বলতে বলতে হাসছিলেন।
উদাহরণ দিন। উদাহরণ না দিলে বুঝব না।
যেমন তাঁর মেয়েটা কেজি থেকে ক্লাস ওয়ানে উঠবে। উনি তার মেয়েকে স্কুলে যাবার জন্যে সাজিয়ে দিচ্ছেন। সাজাতে সাজাতে বললেন— মা আজ তুমি ক্লাস ওয়ানে উঠবে। মেয়েটা তখন গভীর হয়ে বলল, উঠব তো বুঝলাম, কিন্তু নামব কীভাবে?
মবিনুর রহমান বললেন, এই কথায় হাসির অংশ কোনটা? কই আমার তো হাসি আসছে না!
আমি ঠিকমতো বলতে পারিনি। এই জন্যে আপনার হাসি আসেনি।
মেয়েটার নাম কী?
নাম জানি না।
নাম জিজ্ঞেস করেননি?
জি না।
জিজ্ঞেস করেননি কী জন্যে?
জনাব আপনি যদি চান আমি জিজ্ঞেস করে জেনে আসব।
আপনাকে কিছুই জানতে হবে না। আপনি কি কখনো মানুষ খুন করেছেন? জি না জুনাব।
কাউকে খুন করার ইচ্ছা কখনো হয়েছে?
জি না।
জয়নাল সাহেব ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন। মানুষটাকে দেখে তার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। শফিকের জন্যে তার মায়া লাগছে। এই মানুষটার সঙ্গে কাজ করা শফিকের জন্যে নিশ্চয়ই কোনো সহজ কাজ না। আহা বেচারা।
মবিনুর রহমান বললেন, মানুষ খুন না করতে পারেন; কিন্তু খুনের ইচ্ছা হওয়াটা তো স্বাভাবিক। আমার বাবা আমার চার বৎসর বয়সে আমাকে একটা এতিমখানায় দিয়ে চলে যান। আর তাঁর কোনো খোঁজ পাইনি। এই মানুষটার প্রতি আমার কি রাগ উঠবে না?
জয়নাল সাহেব ভয়ে ভয়ে বললেন, উনি হয়তো খুবই অভাবি মানুষ ছিলেন। অভাব মানুষের সব ভালো গুণ নষ্ট করে দেয়। আমিও অভাবের কারণে আমার স্ত্রীকে মেয়ের বাসায় ফেলে রেখে হোটেলে থাকি।