আমজাদ আলি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ভাই দেখো তো একটু চা খাওয়াতে পারে কিনা।
তিনি হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মুখের হাঁ একবারও বন্ধ করছেন না। অফিসের বারান্দায় এখন কেউ নেই শুধু শফিক এবং আমজাদ আলি। আমজাদ আলি চেয়ারে গা ছেড়ে এলিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবেন। শফিক তাঁর সামনে রাখা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। আমজাদ আলি বললেন, ভাই কিছু বলবেন?
শফিক বলল, জি না।
কত বড় বিপদে পড়েছি দেখেছেন ভাই সাহেব। নিঃশ্বাস ঠিকমতো নিতে পারছি না।
শফিক বলল, আপনি একটা কাজ করুন, ঘরের ভেতরে ফ্যানের নিচে বসুন।
এখন নড়তে পারব না। নড়ার ক্ষমতা নাই। পায়ের অবস্থা দেখেন। কি রকম ফুলেছে দেখেছেন। মনে হয় পানি এসে গেছে। আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ডেবে যায়।
আমজাদ আলির চা চলে এসেছে। তিনি চায়ের কাপ হাতে নিয়েই বমি করতে শুরু করলেন। শফিক ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরল। আমজাদ আলি বিড়বিড় করে বললেন, সরি আপনার কাপড় নষ্ট করে দিয়েছি।
আমজাদ সাহেবকে হাসপাতালে নিতে হলো। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন, তেমন কিছু না। বাসায় নিয়ে যান, রোগী রেস্টে থাকুক। সাত দিন কমপ্লিট বেড রেস্ট।
শফিক বলল, চলুন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।
আমজাদ আলি বললেন, আমাকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে না। আমি একটা ইয়েলো ক্যাব নিয়ে চলে যাব। আপনি অনেক কষ্ট করেছেন অরি না।
শফিক বলল, কষ্ট কিছু না আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।
সেটা জানিরে ভাই। স্যার আপনাকে ফুলটাইম গাড়ি দিয়েছেন। আপনি বিরাট ভাগ্যবান মানুষ। একদিন দুটা মিনিট সময় দিবেন আমি আমার কপালটা আপনার কপালে ঘষব।
যাবার পথে আমজাদ সাহেব গাড়ির পেছনের সিটে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে রইলেন। চলন্ত গাড়িতে তিনি মাথা তুলতে পারছেন না। মাথা ঘুরছে। একবার শুধু শফিককে ফিসফিস করে বললেন, কানে ধরে উঠবোসের ব্যাপারটা যেন কেউ না জানে। তাই আপনার পায়ে ধরি। শফিক বলল, কেউ জানবে না।
আমজাদ আলি বললেন, আমার ছোট মেয়েকে তো চিনবেন না। শায়লা নাম। তার বিরাট বুদ্ধি। প্যাচ খেলিয়ে বের করে ফেলবে।
বাসায় পা দিয়েই আমজাদ সাহেব পুরোপুরি সুস্থ। হাঁকাহাঁকি-ডাকাডাকি।
মা দেখ কাকে নিয়ে এসেছি। আমাদের নতুন কলিগ। চা-নাস্তার জোগাড় দেখ গো মা।
শফিককে চা-নাস্তা খেতে হলো। আমজাদ সাহেবের ছোট মেয়ে শায়লার দুটা গান শুনতে হলো। শায়লা রবীন্দ্র সংগীত শিখছে। আমজাদ আলির বাড়িতে যে অতিথিই আসুক শায়লার একটা গান শুনতে হয়। এখন পর্যন্ত সে একটা গানই পুরোপুরি তুলেছে— খোল খোল দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাড়ায়ে।
আমজাদ আলি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ের গলাটা আপনার কাছে কেমন লাগল?
শফিক বলল, খুবই সুন্দর গলা।
আজ তবলা ছাড়া শুনেছেন। তবলা দিয়ে শুনলে আরো ভালো লাগবে। আরেক দিন যদি আসেন তবলা দিয়ে শোনার ব্যবস্থা করব।
আসব আরেক দিন।
আমজাদ আলি মেয়ের দিকে তাকিয়ে অনিন্দিত গলায় বললেন, মাগো তোমার এই গান আরেকবার শুনাও। এইসব গান একবার শুনলে মন ভরে না।
শফিককে একই গান দ্বিতীয়বার শুনতে হলো।
শফিক বাসায় ফিরল রাত দশটায়। নিশো তখনো জেগে। সে শফিককে দেখে ঝাপ দিয়ে পড়ল। নিশো আনন্দিত এবং উত্তেজিত। তার গায়ে নতুন জামা। তার খুব পছন্দের সাজ ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়া। এটা তাকে কখনো করতে দেয়া হয় না। বিশেষ বিশেষ উৎসবে এই সুযোেগটা সে পায়। আজ পেয়েছে। সে ইচ্ছা মতো ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষেছে।
নিশো বলল, বাবা আজ বাসায় পোলাও রান্না হয়েছে।
হঠাৎ পোলাও কেন?
আজ মার জন্মদিন।
ও আচ্ছা তাই তো!
মীরার জন্মদিনের তারিখটা শফিকের কখনো মনে থাকে না। বড় সাহেবের মতো তার যদি কয়েকজন পার্সোনাল ম্যানেজার থাকত তাহলে একজনের ওপর দায়িত্ব থাকতো জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, মেয়ের জন্মদিন এইসব মনে করিয়ে দেয়ার। একজনের ওপরে দায়িত্ব থাকতো কি উৎসব বিবেচনা করে উপহার কিনে আনার। আরেক জন থাকতো ফুড ম্যানেজার। সে উপলক্ষ্য বিবেচনা করে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করবে।
মীরা সুন্দর করে সেজেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। কাজল নামের কালো রঙ কি করে চোখ এত সুন্দর করে কে জানে। মেয়েরা উৎসব উপলক্ষে নতুন শাড়ি পরতে পছন্দ করে। বেচারি একটা পুরনো শাড়ি পরেছে। জন্মদিনের কথা শফিকের কিছুই মনে নেই। মনে থাকলে একটা সুতির শাড়ি সে অবশ্যই কিনত। একটা শাড়ি, কিছু ফুল।
মীরা বলল, গোসল করার আগে কি তোমাকে চা দেব? না গোসল করে চা খাবে?
আগে গোসল করব।
আমার জন্মদিনের কথা তুমি ভুলে গেছ তাই না?
না ভুলিনি।
কেন মিথ্যা কথা বলো। ভুলে গেছ সেটা স্বীকার করলেই হয়। আমার জন্মদিন এমন কোনো বিরাট ব্যাপার না যে তোমাকে মনে রাখতে হবে।
ঝগড়া শুরু করে দিলে?
ঝগড়া শুরু করব কেন? তুমি যে মিথ্যা কথা বলছ এটা শুধু ধরিয়ে দিলাম। তোমার যদি জন্মদিনটা মনে থাকত আর কিছু আনো না আনো কিছু ফুল আনতে।
ফুল আনলেই ভালোবাসা প্রমাণ হয়?
ফুল আনলে প্রমাণ হয় যে তারিখটা তোমার মনে আছে।
তোমার জন্ম তারিখটা খোদাই করে আমার কপালে লিখে দাও না কেন? যতবার আয়নার দিকে তাকাব ততবার জন্ম তারিখ মনে পড়বে।
এখন তুমি ঝগড়া শুরু করেছ। যাও গোসল করে আসো। আজকের দিনটা চিৎকার-চেঁচামেচি না করে পরে করো। প্লিজ হাতজোড় করছি।
শফিক গোসল করছে। মা-মেয়ে দুজনই বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। আজ বৃষ্টি নেই, বৃষ্টির পানির ধারাস্রোত নেই; কিন্তু শফিক গোসলের সময় এমন ভাব করছে যেন তার মাথায় বৃষ্টির পানি পড়ছে। মীরা ব্যাপারটা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। এই অদ্ভুত কাণ্ড শফিক আগেও কয়েকবার করেছে। কাজটা সে নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করে করছে না। সে কি কোনো ঘোরের মধ্যে আছে?