আমার নাম শফিকুল করিম। আমি মবিনুর রহমান সাহেবের নতুন পিএ। চাকরিতে জয়েন করতে এসেছি। স্যার আছেন না?
জি আছেন। উনি চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতেই থাকেন। দোতলায় চলে যান। উনি দোতলায় থাকেন। আমরা স্টাফরা থাকি একতলায়।
সিঁড়ি কোন দিকে?
সোজা যান। শেষ মাথা পর্যন্ত যাবেন। ডাইনে তাকাবেন–সিঁড়ি।
শফিকুল করিম অবাক হয়ে বলল, সোজাসুজি দোতলায় চলে যাব? নিচে কাউকে কিছু জানাতে হবে না?
ক্যাশিয়ার সোবাহান সাহেব আছেন। উনার সঙ্গে দেখা করেন।
উনি কোথায় বসেন?
অফিস ঘরে বসেন। উত্তর দিকে যান। হলুদ রঙের আলাদা একতলা যে দালান দেখতেছেন, ঐটাই অফিস। ক্যাশিয়ার সাব অফিসে আছেন। আচ্ছা ঠিক আছে স্যার, চলেন আপনারে দিয়া আসি।
অফিস ঘরের বারান্দায় মোটামুটি ভালো জটলা। মজার কিছু হচ্ছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তবে কারো মুখেই কোনো কথা নেই। সাপ খেলা নাকি? সাপ খেলার সময় দর্শকরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখে। তবে সাপ খেলা, বাঁদর খেলা এইসব নিম্নবিত্তের জিনিস। বড় মানুষরা বড় খেলা দেখেন। সাপ-খোপ দেখেন না। শফিকুল করিম বলল, ওখানে কী হচ্ছে?
দারোয়ান গলা নামিয়ে বলল, আমজাদ স্যারের শাস্তি হইতেছে।
শাস্তি হচ্ছে মানে কী? কী শাস্তি হচ্ছে?
কাছে গেলেই দেখবেন। কানে ধইরা উঠবোস।
সত্যি সত্যি একজন বয়স্ক চশমা পরা মানুষ কানে ধরে উঠবোস করছে। একজন কাগজ-কলম নিয়ে সামনে আছে। সে মনে হয় উঠবোসের হিসাব রাখছে। যিনি উঠবোস করছেন তাঁর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে গেছে। যিনি হিসাব রাখছেন তিনি বললেন, আমজাদ সাহেব এখন কিছুক্ষণ রেস্ট নেন। পানি খান।
উঠবোস করা মানুষটা সবুজ রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসল। চেয়ারের সামনে স্ট্যান্ড ফ্যান। একজন এসে ফ্যানের মুখ ঘুরিয়ে দিল। আমজাদ নামের মানুষটা হাঁ করে ফ্যানের বাতাস মুখে নিচ্ছে। মানুষটা ফর্সা, এখন তাকে টকটকে লাল দেখাচ্ছে। তার হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি গ্লাস হাতে বসে আছেন। গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন না।
কাগজ-কলম হাতে মানুষটা শফিকুল করিমের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, আপনের এইখানে কী? কী চান?
ক্যাশিয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।
অফিসে যান। বারান্দায় ভিড় করছেন কেন? এখানে মজা দেখার কিছু নাই।
শফিকুল করিম অফিস ঘরে ঢুকল।
একটা আইবিএম পার্সোনাল কম্পিউটারের সামনে যে লোক বসে আছে সেই সম্ভবত সোবাহান সাহেব। ভগ্ন স্বাস্থের একজন মানুষ। চোখের নিচে কালি। গাল ভাঙা। খালা-খাবলাভাবে মাথার চুল উঠছে। বয়স খুব বেশি হবে না, তবে দেখাচ্ছে অনেক বেশি। গরমের মধ্যেও তিনি হলুদ রঙের কোট গায়ে দিয়ে আছেন।
ভদ্রলোকের গলার স্বর মেয়েদের মতে, তিনি শফিকুল করিমের দিকে তাকিয়ে প্রায় কিশোরীদের মতো গলায় বললেন, আপনার কী ব্যাপার?
আমার নাম শফিকুল করিম। আমি চাকরিতে জয়েন করতে এসেছি।
বুঝেছি। বসেন। কেমন আছেন?
ভালো।
স্যার আপনার কথা বলেছেন। কবে জয়েন করবেন সেটা বলেন নাই। আসছেন ভাল করেছেন। আজ দিন ভালো— বৃহস্পতিবার। চা খাবেন?
জি না। প্র
থম দেখা আপনার সঙ্গে। চা খান। আলাপ-পরিচয় হোক।
আপনার এইখানে কি সিগারেট খাওয়া যাবে?
যাবে। সিগারেট ধরান কোন সমস্যা নাই।
ক্যাশিয়ার সাহেব বিরক্ত মুখে বেল টিপতে লাগলেন। এই কাজটা মনে হয় তিনি পছন্দ করেন না। অনেকক্ষণ বেল টেপার পর একজন ঘরে ঢুকল। সোবাহান সাহেব রাগী গলায় বললেন, বেলের শব্দ কানে যায় না? সব বারান্দায় বসে আছ। রঙ্গ দেখ? রঙ্গ গুহ্য দ্বার দিয়ে চুকায়ে দেব গুহ্য দ্বার চিনো? যাও দুই কাপ চা আনো।
শফিকুল করিম ক্ষীণ গলায় বলল, বারান্দায় কী হচ্ছে?
কানে ধরে উঠবোস করানো হচ্ছে। আমাদের আগের ম্যানেজার। আমজাদ নাম। অপরাধ করেছিল, চাকরি চলে গেছে। স্যারের কাছে কেঁদে পড়েছে। স্যার বলেছেন পঞ্চাশ হাজার বার কানে ধরে উঠবোস করলে চাকরি ফেরত পাবে। তাই করছে।
কতবার বললেন?
পঞ্চাশ হাজার বার। ফিফটি থাউজেন্ড।
বলেন কী?
পারবে না। সাত দিন ধরে উঠবোস করছে, মাত্র চৌদ্দশ, না পনেরোশ, হয়েছে। বেশিক্ষণ করতে পারে না। পা ফুলে যায়। তার ওপর আছে হাঁপানি। আজকে উঠবোস করতে আসছে জ্বর নিয়ে। আমি বলেছিলাম আজকে অফ রাখতে।
শফিকুল করিম সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এ রকম শাস্তি কি এখানে প্রায়ই হয়?
না । এখানে কোনো শাস্তি হয় না। চাকরি চলে যায়। উঠবোস যেটা করছে সেটা চাকরি ফেরত পাওয়ার জন্যে। খামখা পরিশ্রম করছে। পারবে না। আপনি কি চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? বিসকিট, চানাচুর?
জি না।
রাতে কি থাকবেন না চলে যাবেন?
চাকরির শর্ত কী? রাতেও থাকতে হবে?
স্যার যে রকম বলেন সে রকম। তবে রাতে থাকেন বা না থাকেন এখানে আপনার জন্যে ঘর থাকবে। বিশ্রাম নিতে পারবেন। খাওয়া-দাওয়া আমাদের সঙ্গে করবেন। স্টাফদের রান্না আলাদা হয়। বাবুর্চির রান্না খুবই ভালো। মাছমাংস দুটাই থাকে। রাতে যদি রুটি খাওয়ার অভ্যাস থাকে, বাবুর্চিকে আগে বলে দিবেন। রুমালি রুটি করে দেবে, মসলিন কাপড়ের মতো পাতলা।
বাবুর্চির নাম কী?
যাকে চায়ের কথা বললাম, সে-ই বাবুর্চি, নাম ছগির। ঢাকা শহরে ছগিরের মতো বাবুর্চি আছে বলে মনে হয় না। তার খাসির মাংসের রেজালা তুলনাবিহীন। চাকরিতে যখন ঢুকেছেন তখন তার রান্না অবশাই খাবেন। আমার কথা যাচাই করে নিতে পারবেন।