জি স্যার।
ঢেড়সের ইংরেজি বাচ্চারা বলবে Ladies Finger মেয়েমানুষের আঙ্গুল।
এটাও ঠিক না। তেঁড়সের ইংরেজি হলো OKRA. আপনার ছেলেমেয়ে আছে?
স্যার একটা ছেলে।
ইংরেজি কেমন জানে?
জানি না স্যার। আমি মুখ মানুষ কিভাবে জানব।
একদিন নিয়ে আসবেন আমার কাছে। আমি টেস্ট করে দেখব।
স্যার আপনার অনেক মেহেরবানী।
আপনার গাড়িতে গান-বাজনার ব্যবস্থা আছে?
জি স্যার আছে।
গান দিয়ে দেন। গান শুনতে শুনতে যাই।
কি গান দিব স্যার?
আপনার যেটা ইচ্ছা দেন।
ড্রাইভার গান ছেড়ে দিল। জয়নাল সাহেব গানের তালে তালে মাথা দুলাতে লাগলেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এই জগতে তাঁর মতো সুখী মানুষ আর কেউ নেই। গানের কথাগুলোও তাঁর কাছে ভালো লাগছে। কী সুন্দর কথা—
একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘবরন কেশ।
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ ॥
জয়নাল সাহেবের মনে হলো তিনি চোখের সামনে ভাটি অঞ্চলের সোনার কন্যাকে দেখতে পারছেন, যার কেশ মেঘবরন। সোনার কন্যার সঙ্গে তিনি তাঁর পুত্রবধূ মীরার আশ্চর্য সাদৃশ্যও লক্ষ্য করলেন।
মুবিনুর রহমান শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন
মুবিনুর রহমান শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। একবারও চোখের দৃষ্টি সরাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে সামান্য ঝুঁকে আসছেন আবার সরে যাচ্ছেন। রকিং চেয়ারে বসে থাকার সময় যা করেন তাই। অথচ তিনি এখন রকিং চেয়ারে বসে নেই। তিনি বসে আছেন তাঁর শোবার ঘরের মেঝের কার্পেটে। শফিক বসেছে তাঁর সামনে। এই ঘরে আজ সে প্রথম ঢুকল। বড় সাহেবের শোবার ঘর হিসেবে এই ঘরটা ছোট। বেশ ছোট। তারচে বড় কথা এখানে কোনো খাট নেই। আসবাবপত্র নেই। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট আছে। ঘরের এক কোনায় বালিশ, কোলবালিশ এবং কম্বল দেখা যাচ্ছে। বড় সাহেব সম্ভবত সেখানে ঘুমান। হয়তো তিনি খাটে ঘুমাতে পারেন না। হয়তো ডাক্তার বলে দিয়েছে মেঝেতে ঘুমুতে। কিংবা তিনি নিজেই হয়তো শখ করে মেঝেতে শুয়ে থাকেন। বড় মানুষরা বিচিত্র কর্মকাণ্ড করতে ভালোবাসেন।
বাবুল।
জি স্যার।
লায়লা তোমাকে দুপুরে ভাত খাইয়েছে?
জি স্যার।
মেনু কী ছিল বলো তো?
বেগুন ভাজি, মুরগির মাংসের ঝোল।
ডলি ছিল না?
ডাল ছিল স্যার।
ডালের কথাটা বাদ দিলে কেন? আমার কাছে যখন কোনো বিষয়ে রিপোের্ট করবে তখন কিছুই বাদ দেবে না। কী ডাল ছিল, মসুর ডাল না মুগ ডাল?
মুগ ডাল।
মুরগির ঝোলে কোনো তরকারি ছিল?
পেঁপে ছিল। আলুর মতো গোল করে কাটা পেঁপে।
ভালো মতো চিন্তা করে দেখো কোনো ডিটেল কি বাদ গেছে?
জি না স্যার।
সব বলা হয়েছে?
জি স্যার।
লেবু ছিল না?
ছিল স্যার।
লেবুর কথা তো বাদ দিলে। চিন্তা করে দেখো আর কিছু কি বাদ গেছে?
জি না স্যার।
একটা ব্যাপার বাদ দিয়ে গেছ। তোমার সঙ্গে তোমার বাবা ছিলেন। এই কথাটা বলোনি।
শফিক হকচকিয়ে গেল। সে তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে এই তথ্য বড় সাহেব জানবেন সে ভাবেনি। তিনি কি রাগ করেছেন? তার মুখ দেখে সে রকম মনে হচ্ছে না। হাসি হাসি মুখ। চোখের দৃষ্টি যদিও তীক্ষ্ণ।
তোমার বাবা কি দুপুরের খাবার খেয়ে খুশি হয়েছিলেন?
জি স্যার। খুব খুশি হয়েছেন।
খাবারের আয়োজন তো তেমন কিছু না। তাহলে খুব খুশি কেন হলেন?
আমার বাবা অল্পতেই খুশি হন। তাছাড়া ম্যাডাম খুব যত্ন করেছেন।
খুব যত্ন করেছেন মানে কী? তোমরা যখন খাচ্ছিলে তখন পাখা দিয়ে বাতাস করছিল?
ম্যাডাম আন্তরিকভাবে গল্পগুজব করছিলেন। বাবার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশাও করছিলেন। যেন আমরা তার খুবই পরিচিত।
কি ঠাট্টা-তামাশা করছিল একটু বলো তো শুনি।
আমি বলতে পারব না স্যার। যখন ঠাট্টা-তামাশা করছিলেন তখন আমি বারান্দায় ছিলাম।
বারান্দায় ছিলে কেন?
আমার সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে, আমি সিগারেট খাবার জন্যে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম।
তুমি বারান্দায় ছিলে, তাহলে কী করে বুঝলে যে ঠাট্টা-তামাশা হচ্ছিল?
আমি ওনাদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
লায়লাও হাসছিল?
জি স্যার।
কি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছিল এটা তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে না?
জানা যাবে।
সোবাহানকে বলো একটা গাড়ি পাঠিয়ে সে যেন তোমার বাবাকে আমার এখানে নিয়ে আসে। রাত নটার দিকে আনবে।
জি আচ্ছা স্যার।
তোমার কপাল ঘেমে গেছে। ঘর যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তোমার কপাল ঘামছে কেন? শফিক জবাব দিতে পারল না। তার কি হার্ট এটাকের মতো হচ্ছে? হার্ট এটাকের সময় ঘাম হয়।
বড় সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অচ্ছাি তুমি এখন যাও। আমজাদ আলির শাস্তি কোন পর্যায়ে আছে খোঁজ নাও।
শফিক দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো।
আমজাদ আলি উঠবোস করছেন। হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। বুক ওঠানামা করছে। তার পরনের ছাই রঙের পাঞ্জাবির পুরোটাই ঘামে ভিজে জবজব করছে। আগে উঠবোস করার সময় স্ট্যান্ড ফ্যানে বাতাস দেয়া হতো। আজ বাতাস দেয়া হচ্ছে না। মনে হয় ফ্যান নষ্ট। আমজাদ আলির বয়সও মনে হয় কয়েক দিনে অনেক বেড়েছে। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে। চোখের নিচে কালি।
শফিক তাঁর সামনে দাঁড়াতেই তিনি উঠবোস বন্ধ করে পাশের চেয়ারে বসলেন।
যে উঠবোসের হিসাব লিখছিল সে বলল, স্যার আরো করবেন না এই পর্যন্ত?
আমজাদ আলি বললেন, আজ আর পারব না। কত হয়েছে? টোটাল কত?
তিন হাজার ছয়শ একত্রিশ।
এত কম? এই জীবনে মনে হয় শেষ করতে পারব না।
বাসায় চলে যান। কয়েকটা দিন রেস্ট নেন। একসঙ্গে বেশি করা ঠিক হবে না।