শফিক গাড়ি থামিয়ে চারটা ফুলের মালা কিনল।
একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। বাগানে যত্ন নেয়া হয় এটা বোঝা যাচ্ছে। বাড়ির সামনে গোল বারান্দার মতো আছে। সেখানে সিলিং থেকে ফুলের টব ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। বারান্দায় বেতের চেয়ার পাতা। সব মিলিয়ে কেমন সুখী সুখী ভাব।
যে মহিলা দরজা খুললেন তার মুখও সুখী সুখী। মোটাসোটা একজন মহিলা। মাথার চুল লালচে। মনে হয় মেন্দি দিয়ে রঙ করেছেন। মুখ ভর্তি পান। এই বয়সেও ভদ্রমহিলা যথেষ্টই রূপবতী। পাতলা ঠোঁট। বড় বড় চোখ-মুখ গোলাকার যেন কম্পাস দিয়ে মুখ আঁকা হয়েছে।
শফিক বলল, ম্যাডাম আমার নাম শফিক। শফিকুল করিম। আমি মবিনুর রহমান সাহেবের পিএ। স্যার আপনার জন্যে কিছু ফল পাঠিয়েছেন।
আমার জন্যই পাঠিয়েছেন এটা এত নিশ্চিত হয়ে বলছেন কীভাবে? আপনি তো আমাকে চেনেন না। আমার ছবি দেখার কথাও না। আপনি আমার কোনো ছবি দেখেননি। আপনার স্যারের কাছে আমার কোনো ছবি নেই। আসুন ভেতরে আসুন।
শফিক বসার ঘরে ঢুকল।
জুতা খুলে আসুন। কাউকে জুতা খুলে ঘরে ঢুকতে বলা খুবই অভদ্রতা। এই অভদ্রতা বাধ্য হয়ে করছি।
শফিক বসার ঘরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর করেই না ঘরটা সাজানো। মেঝেতে শীতল পাটি বিছানো। সোফা নেই, কুশনের ওপর বসার ব্যবস্থা। প্রতিটি কুশন সাদা ওয়ার দেয়া। সেখানে সূচির কাজ আছে। নীল সুতায় করা নকশা। দেয়ালে বাঁশের ফ্রেমে জলরঙের সুন্দর ছবি।
ভদ্রমহিলা শফিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘরে ঢুকলেই শান্তি শান্তি ভাব হয় না?
জি হয়।
আমার কিন্তু হয় না। ঘর সাজানোর শখ আমার মেয়ের, আমার না। বসুন। আমি ছাত্র পড়িয়ে কূল পাই না ঘর সাজাব কী?
শফিক বসল। ভদ্রমহিলা শফিকের সামনে বসতে বসতে বললেন, আমাকে ফল পাঠানো খুবই হাস্যকর ব্যাপার। আমি ফল খাই না। যে কোনো ফল খেলেই আমার এসিডিটি হয়। আমার মেয়েও খায় না। কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যে পাঠাব সেটাও সম্ভব না। আমার লোকবল নেই। একটা মেয়ে নিয়ে সংসার।
আপনি যদি ঠিকানা লিখে দেন আমি আপনার আত্মীয়স্বজনের বাসায় পৌঁছে দেব। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।
আপনাকে ফল নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে হবে না।
ম্যাডাম আমার কোনো অসুবিধা নেই।
আপনার অসুবিধা না থাকতে পারে। আমার আছে।
ম্যাডাম আমাকে তুমি করে বলবেন।
তুমি করে বলব কেন?
লায়লা প্রশ্নটা এমনই কঠিন করে করলেন যে শফিক হকচকিয়ে গেল। মহিলা তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে যেন প্রশ্নের জবাব না দেয়া পর্যন্ত দৃষ্টি ফেরাবেন না।
আপনার নাম শফিক তাই না?
জি ম্যাডাম।
আপনি আমার প্রতি অতি বিনয় দেখাচ্ছেন তার কারণ আপনার স্যার আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। এই থেকে আপনার ধারণা হয়েছে আমি বিশেষ কেউ। আসলে কিন্তু তা না। কাজেই প্রতি সেকেন্ডে একবার করে ম্যাডাম ডাকা বন্ধ।
জি আচ্ছা। কী ডাকব?
কিছু কি ডাকতেই হবে?
মহিলা আবারো আগের মতো কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। শফিক অস্বস্তি বোধ করছে। হঠাৎ করেই ভদ্রমহিলার চোখের দৃষ্টি কোমল হলো। তিনি বললেন, গাড়িতে একজন বুড়ো মতো ভদ্রলোক বসে আছেন, উনি কে?
আমার বাবা। আমার সঙ্গে এসেছেন।
তাঁকে গাড়িতে বসিয়ে রেখেছেন কেন। নিয়ে আসুন। আমি চা বানাচ্ছি–চা খাবেন।
ম্যাডাম আমি চা খাব না।
চা না খেলে অন্য কিছু খাবেন।
আপনি কি জানেন আপনার স্যারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল?
জানি।
সবচে ক্ষণস্থায়ী বিয়ে। গিনেস বুকে ওঠার মতো ব্যাপার। আমার বিবাহিত জীবন ছিল দেড় ঘণ্টার।
স্যরি কিন্তু বলেছেন সাত ঘণ্টা।
উনি তাই বলেছেন?
জি। রাত একটা দশে বিয়ে হয়েছিল ভোর আটটা দশে বিয়ে ভেঙে যায়।
তাহলে তো বেশ দীর্ঘস্থায়ী বিয়ে। গিনেস বুকে ওঠার মতো না।
ভদ্রমহিলা হাসছেন। হাসলে সব মানুষকেই সুন্দর লাগে, এই মহিলাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে এই মহিলা দূরের কেউ না। কাছের একজন। শফিক বলল, ম্যাডাম আমি কি আমার বাবাকে নিয়ে আসব?
অবশ্যই। এখন বাজে দুপুর দেড়টা। দুপুর বেলার অতিথিকে আমি শুধু চাঁ খাইয়ে বিদায় করব এটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। দুপুর বেলা আপনারা দুজন আমার সঙ্গে খাবেন। আয়োজন খুবই সামান্য তাতে কী?
ফেরার পথে জয়নাল সাহেব ছেলের পাশে বসলেন না। ড্রাইভারের পাশে বসলেন। ড্রাইভারের পাশের সিটটা বসার জন্যে সবচে ভালো। পা ছড়িয়ে বসা যায়। সামনের দৃশ্য দেখা যায়। ছেলের সঙ্গে না বসার পিছনে আরেকটি কারণও আছে, ছেলে হয়তো সিগারেট খাবে। বাবার পাশে বসলে সেটা সম্ভব না। সিগারেট টানতে টানতে ভ্রমণের আলাদা মজা, সেই মজা থেকে ছেলেকে বঞ্চিত করা ঠিক না। একজন আদর্শ পিতার উচিত তাঁর ছেলে-মেয়েদের প্রতিটি খুঁটিনাটির দিকে লক্ষ্য রাখী। তিনি তা পারছেন না। কারণ তিনি কোনো আদর্শ পিতা না। আদর্শ পুত্র হওয়া সহজ। আদর্শ পিতা হওয়া সহজ না। তিনি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ড্রাইভার সাহেব আপনার নাম কী?
ড্রাইভার বলল, স্যার আমার নাম রঞ্জু।
দুপুরের খাওয়া ঠিকমতো করেছেন?
জি স্যার।
খাওয়া ভালো ছিল না?
জি ছিল।
বেগুন ভাজি ভালো ছিল না?
জি।
বেগুনের ইংরেজি হলো Bringal. বাচ্চাকাচ্চারা সজির ইংরেজি কম জানে। আলুর ইংরেজি সবাই বলতে পারবে Potato কারণ আলু তার খায়। শব্জি খায় না এই জন্যে শব্জির ইংরেজি জানে না। বেগুলের ইংরেজি বলতে পারবে না, পটলের ইংরেজিও না। বুঝতে পারছেন?