ধরা যাক তারপরেও তিনি থাকতে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে এই খবর ছেলের মার কানে যাবে। এই মহিলা বাস করেন তাঁর বড় মেয়ের সঙ্গে। মহিলার আছে Carp সমস্যা। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করা। তিনি শুরু করবেন ঘ্যানঘ্যান, তুমি ছেলের সংসারে সুখে থাকবে আমি কেন মেয়ে জামাই-এর সঙ্গে থাকব? তুমি যেখানে থাকবে আমি থাকব সেখানে। মেয়ে জামাই-এর সংসারে আমি আর থাকব না। প্রয়োজনে আমি তোমার হোটেলে এসে উঠব। এই মহিলার মাথায় সামান্য ছিট আছে। বিছানা-বালিশ নিয়ে হোটলে চলে আসতে পারে। যদি আসে বিরাট সমস্যা হবে।
স্বামী-স্ত্রী দুজন একসঙ্গে ছেলের কাছে থাকতে যাবেন সেটা এই মুহূর্তে অসম্ভব। ছেলে খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। তার নিজেরই দিন চলে না। কোনো চাকরিতে সে স্থির হতে পারছে না। তার সংসারে বিরাট অভাব। বিয়ের সময় বউমাকে তার মা সামান্য কিছু গয়না দিয়েছিলেন। সোনার চুড়ি, চেইন, কানের দুল। এখন বউমার শরীরে কোন সোনাদানা নেই। বিবাহিত মেয়েরা সব সময় গায়ে কিছু না কিছু সোনা রাখে। এই মেয়ের গায়ে কিছুই নাই কেন তা কি তিনি জানেন না? ঠিকই জানেন। এমন যাদের সংসারের অবস্থা তাদের ঘাড়ে দুই বুড়োবুড়ি সিন্দাবাদের ভূতের মধ্যে চেপে বসতে পারেন না। সিন্দাবাদকে মাত্র একজন বুড়ো কাঁধে নিতে হয়েছে এখানে তারা দুই জন।
আজ শুক্রবার। জয়নাল সাহেবের ছুটির দিন। ছাত্র পড়াতে যেতে হবে না। তারপরেও তিনি ঠিক করলেন যাবেন। মনসুরের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করবেন। ছেলের বাড়িতে খালি হাতে উপস্থিত হওয়া ঠিক না। বাচ্চা একটা মেয়ে আছে। তার জন্যে কিছু না কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত। শিশু কন্যাকে উপহার দেবার বিষয়ে নবিজির হাদিসও আছে— যে ব্যক্তি তার শিশু কন্যার জন্যে উপহার নিয়ে যায় সে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্যদানের পুণ্য সঞ্চয় করে।
জয়নাল সাহেব সকাল আটটায় মনসুরের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে শুনলেন কিছুক্ষণ আগেই মনসুর তার ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেছে। আজ আর ফিরবে না। তিনি হোটেলে ফিরে এলেন। অনেক চিন্তাভাবনা করে হোটেলের ম্যানেজার কায়েস মিয়ার কাছে গেলেন। ধার হিসাবে একশ টাকা পাওয়া যায় কিনা। কায়েস মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, স্যারের হুকুম ছাড়া টাকা পয়সার লেনদেন আমার জন্যে নিষেধ আছে। তিনি নিজের ঘরে এসে এখন কি করা উচিত ভাবতে বসলেন। হেঁটে হেঁটে রওনা দেবেন? যতক্ষণ পারবেন হাঁটবেন। তারপর রিকশা নিয়ে নেবেন। ছেলের বাসায় পৌঁছে মীরাকে বলবেন রিকশা ভাড়াটা দিয়ে দিতে। সমস্যা হবে যদি মীরার কাছে রিকশা ভাড়া না থাকে। থাকবে নিশ্চয়ই। মেয়েদের কাছে গোপন কিছু টাকা সব সময়ই থাকে। তবে তিনি চেষ্টা করবেন হেঁটে হেঁটে যেতে। বিশ্রাম করতে করতে যাবেন, সমস্যা কী? সঙ্গে ছাতা থাকতে হবে। বৃষ্টি-বাদলার দিন, কখন বৃষ্টি নামে তার নেই ঠিক। ছাতা একটা জোগাড় করতে হবে। তাঁর নিজের ছাতা গত বৎসর বর্ষার সময় হারিয়ে ফেলেছিলেন আর কেনা হয়নি। ম্যানেজার কায়েস মিয়ার কাছে ছাতা চাইলে সে কি ছাতা জোগাড় করে দেবে নাকি সে বলবে— স্যারের হুকুম ছাড়া ছাতা দিতে পারব না।
দরজায় টুক টুক করে টোকা পড়ছে। শফিক এই ভঙ্গিতেই দরজায় টোকা দেয়। সে কি এসেছে? জয়নাল সাহেবের বুকে ছলাৎ করে একটা শব্দ করল। তিনি মনের উত্তেজনা গোপন করে কোলের ওপর ডিকশনারি নিতে নিতে বললেন, দরজা খোলা। কোলে ডিকশনারি নেয়ার পেছনে কারণ হলো যদি শফিক হয় তাহলে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন ডিকশনারির পাতা উল্টাতে উল্টাতে। যেন ছেলে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। সে দেখা করতে এলেও কিছু না। না এলেও কিছু না।
বাবা কেমন আছ?
ভালো। বোস।
তিনি আড়চোখে ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন। ছেলে কোথায় বসে এটা দেখার বিষয় আছে। সে চেয়ারে বসতে পারে, তাহলে বাবার কাছ থেকে অনেকটা দূরে বসা হয়। আবার বাবার কাছে খাটে বসতে পারে। তার ধারণা ছেলে বাবার কাছাকাছি বসবে। দেখা যাক অনুমান সত্যি হয় কিনা।
শফিক খাটে এসে বসল।
তিনি ডিকশনারির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, বৌমার শরীর কেমন?
ভালো।
নিশো?
সেও ভালো।
টিফিন ক্যারিয়ারে করে কী এনেছিস?
মীরা সকাল বেলা খিচুড়ি মাংস রান্না করেছিল। তোমার জন্যে নিয়ে এসেছি। বাবা তুমি নস্তিা করে ফেলেছ?
এতবেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকব নাকি?
দুপুরে খেও। কাউকে বললে গরম করে দেবে না?
দেবে। বাসি খাবার খেয়ে কোনো আরাম নেই। দেখ তো টেবিলের ওপর একটা চামচ আছে কি না। গরম গরম খাই।
জয়নাল সাহেব খুবই আরাম করে খাচ্ছেন। ঘরের রান্নার স্বাদ তুলনাবিহীন। খেতে খেতেই তিনি লক্ষ্য করলেন শফিক বালিশের নিচে কিছু রাখল। এটা শফিকের স্বভাব, যতবারই আসে বালিশের নিচে টাকা-পয়সা রেখে যায়। গোপনে রাখে। সরাসরি বাবার হাতে তার টাকা দিতে লজ্জা লাগে। বালিশের নিচে শফিক যখন টাকা রাখে তখন তিনি নিজেও এমন ভাব করেন যেন দেখতে পাননি।
তোর মার কোনো খবর আছে?
মা ভালো আছেন। বাবা শোনে আমি নতুন একটা চাকরি পেয়েছি।
কী চাকরি?
একজন বিশাল বড়লোকের পার্সোনাল ম্যানেজার।
কাজটা কী?
মাত্র তো জয়েন করেছি— এখনো বুঝতে পারছি না কাজটা কি।
যে কাজই করবি মন দিয়ে করবি।
কাজটা টিকবে কিনা বুঝতে পারছি না। যদি টেকে বড় একটা বাসা ভাড়া করব। তোমাকে আর মাকে আমার সঙ্গে রাখব।