সেই চিঠি এবং ডিকশনারি জয়নাল সাহেবের সঙ্গে এখনো আছে। আগে প্রায়ই চিঠি বের করে পড়তেন। কাগজটা ন্যাতা ন্যাতা হয়ে গেছে বলে এখন আর পড়েন না। ডিকশনারির ভেতর কাজ করে রেখে দিয়েছেন। অবশ্যি পড়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না। চিঠির পুরোটাই তার মুখস্থ। চিঠিতে একরামুদ্দিন লিখেছেন–
জনাব ডিকশনারি,
আরজ গুজার। আশা করি আল্লাহপাকের অসীম অনুগ্রহে মঙ্গল মতো আছেন। অনেক বিচিত্র কর্মকাণ্ডের জন্য মনুষ্য সমাজ খ্যাত। আপনার ডিকশনারি মুখস্থ তার মধ্যে পড়ে। আপনি জটিল কর্ম সমাধা করিয়াছেন। আপনাকে অভিনন্দন। আপনাকে দেখিয়া আপনার ছাত্ররাও মুখস্থ বিদ্যায় আগ্রহী হইবে ইহা অনুমান করিতে পারি। এর ভালো দিক অবশ্যই আছে। আপনাকে উপহার স্বরূপ একটি ডিকশনারি পাঠাইলাম। ডিকশনারিটা পুরাতন। পুরাতন হইলেও আপনার পছন্দ হইবে।
আল্লাহপাক আপনাকে ভালো রাখিবেন ইহাই আপনার প্রতি আমার শুভ কামনা।
ইতি
একরামুদ্দিন খান।
চামড়ায় বাঁধানো এই ডিকশনারি জয়নাল সাহেবের অতি প্রিয়বস্তুর একটি। তিনি প্রতিদিন কিছু সময় ডিকশনারি নিয়ে বসেন। পাতা উল্টান। শব্দগুলো দ্রুত পড়েন। সব সময় চর্চায় থাকেন। মুখস্থ বিদ্যা চর্চার জিনিস। কোরানে যারা হাফেজ তাদেরকেও প্রতিদিন কিছু সময় কোরান পাঠ করতে হয়।
জয়নাল সাহেব বর্তমানে বাস করেন খিলগাঁয়ের এক হোটেলের (বেঙ্গল হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট) দুই তলা ২৩ নাম্বার ঘরে। এখানে থাকার জন্যে তাকে কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয় না; কারণ বেঙ্গল হোটেলের মালিক মনসুর তাঁর এক সময়ের ছাত্র। হোটেলে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে তিনি মনসুরের চার ছেলেমেয়েকে দুই বেলা ইংরেজি পড়ান। মনসুর তাকে যথেষ্টই ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। যতবারই দেখা হয় ততবারই বলে, টাকা-পয়সা লাগলে বলবেন। লজ্জা করবেন না। ছাত্র এবং পুত্রের মধ্যে বেশকম কিছু নাই। এটা আপনারই কথা। আমার কথা না। এত জ্ঞানের কথা আমি জানি না।
তিনি টাকা-পয়সার ভয়াবহ টানাটানির মধ্যে থাকেন তারপরও মনসুরের কাছে এখন পর্যন্ত কিছু চাননি। আজ মনে হয় চাইতে হবে। তাঁর হাতে কোন টাকা-পয়সা নাই। সকাল থেকে ইচ্ছা করছে ছেলেকে দেখতে। ছেলে থাকে কলাবাগানের গলির ভেতর। খিলগাঁ থেকে হেঁটে হেঁটে ছেলের কাছে যাওয়া সম্ভব না। গত রাতে তিনি ছেলেকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। একটা খাটের ওপর ছেলে, ছেলের বউ মীরা আর তাদের মেয়ে নিশো বসে আছে। তিনজনই ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। কান্নার শব্দ শুনে তিনি তাদের কাছে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
মীরা বলল, বাবা ও ইংরেজি পরীক্ষায় ফেল করেছে। এখন কী হবে বাবা? তিনি বললেন, সে তো ইংরেজিতেই পাস করেছে, ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রি পেয়েছে। এমএ ডিগ্রি তো সহজ ব্যাপার না।
মীরা চোখ মুছতে মুছতে বলল, তাকে দশটা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করেছে। একটাও পারে নাই।
তিনি ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, কি কি শব্দ জিজ্ঞেস করেছে আমাকে বল দেখি। কান্নার সময় পাওয়া যাবে। শব্দগুলো বল।
শফিক ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, Carp.
Carp পারিস নাই? Carp হলে একটা ভার্ব। নাউন না। এর মানে–Complain continually about unimportant matters সহজ বাংলা হল–ঘ্যানঘ্যান করা। আর কি পারিস নাই বল দেখি—
স্বপ্নের এই পর্যায়ে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। বালিশের নিচ থেকে ঘড়ি এনে দেখেন রাত বাজে দুটা। বাকি রাত তার আর ঘুম হয়নি। তিনি কিছুক্ষণ শুয়ে, কিছুক্ষণ বসে, কিছুক্ষণ হোটেলের বারান্দায় হাঁটাহাটি করে সময় পার করেছেন। ছেলের জন্যে খুবই মন খারাপ লেগেছে। তার কোনো বিপদ হয়নি তো? আল্লাহপাক বিপদ-আপদের খবর মানুষের কাছে ইশারার মাধ্যমে পৌঁছান। একবার তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন লাল রঙের একটা সাপ কামড় দিয়ে তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কামড়ে ধরেছে। তিনি অনেক ঝাকাঝাকি করেও সাপটা ছাড়াতে পারছেন না। এই স্বপ্ন দেখার কিছুদিন পরই স্কুলের বারান্দায় পিছলে পড়ে তার ডান পা ভেঙে যায়। স্বপ্নের অর্থ তো অবশ্যই আছে। সবাই সব অর্থ ধরতে পারে না।
শফিক তার বড় আদরের ছেলে। ছেলে আশপাশে থাকলে তার এতই ভালো লাগে যে গলা ভার ভার লাগে। মনে হয় কেঁদে ফেলবেন। ছেলের দিকে এই জন্যেই তিনি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকেন না। তিনি নিশ্চিত বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অবশ্যই তাঁর চোখে পানি আসবে। ছেলে তখন অতি ব্যস্ত হয়ে বলবে, বাবা কী হয়েছে? ছেলেকে তখন মিথ্যা করে বলতে হবে কিছু হয় নাই। চোখে কি যেন পড়েছে। ছাত্র এবং পুত্র এই দুই শ্রেণীর কাছে মিথ্যা বলা গুরুতর অন্যায়।
তাঁর এখন উচিত ছেলের সংসারে বাস করা। নিজের জন্যে না, নাতনীটার জন্যে। তিনি তাদের সঙ্গে থাকলে নিশোকে ভালমতো ইংরেজিটা ধরিয়ে দিতে পারতেন। বিদেশী ভাষা অল্প বয়সেই ধরিয়ে দিতে হয়। মগজ নরম থাকতেই কাজটা করতে হয়। মগজ একবার শক্ত হয়ে গেলে বিরাট সমস্যা।
ছেলের সংসারে বাস করা তার কাছে কোনো ব্যাপার না। ব্যাগ-স্যুটকেস নিয়ে চলে গেলেই হয়। ছেলে খুবই খুশি হবে। সে অনেকবারই তাকে বলেছে। ব্যাগ-স্যুটকেস নিয়ে টানাটানি পর্যন্ত করেছে। নানা কারণেই ছেলের সঙ্গে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের একটামাত্র শোবার ঘর। একটাই বাথরুম। সেই বাথরুম শোবার ঘরের সঙ্গে। তাঁকে রাতে কয়েকবার বাথরুমে যেতে হয়। বাথরুম পেলে তিনি কী করবেন? ছেলে এবং ছেলের বউকে ঘুম থেকে তুলে তারপর বাথরুমে যাবেন? এক রাতে তাদের কয়বার ঘুম থেকে তুলবেন?