সেই জায়গাটা কোথায়?
কোথায় তুমি খুঁজে বের করো। তোমার মঞ্জু মামাকে জিজ্ঞেস করো।
ওনার কথা আনলে কেন?
ইচ্ছা হয়েছে এনেছি। যতবার ইচ্ছা হবে আনব। এখন সামনে থেকে যাও।
মীরা শোবার ঘরে ঢুকে গেল। তার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। সে ঠিক করে রেখেছিল, নিশোর বাবা অফিস থেকে ফেরার পর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জলিলের ঝিগাতলার বাসায় নিয়ে যাবে। রাতটা সেখানে থাকবে। শফিক খুব আপত্তি করবে বলেও তার মনে হয়নি। মেয়ের টানে যেতে রাজি হবে। জন্মদিনের ভালো খাবার আছে। মানুষটা ভালো খাবার পছন্দ করে। আর যেতে রাজি না হলেও তাদের সময়টা খারাপ কাটবে না। বিয়ের প্রথম দিকের মতো শুধু তারা দুজন।
শফিক হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে। শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকায় মীরা খাটে বসে তাকে দেখতে পাচ্ছে। সে এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। শফিকের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা আরেকবার করে দেখবে? মানুষটা কি কারণে রাগ করে আছে সেটা জানতে পারলে চেষ্টাটা সহজ হতো। সে চায়ের সঙ্গে সিগারেট খেতে পছন্দ করে। এক কাপ চা নিয়ে তার কাছে যাওয়া যায়। এতে তার রাগ না কমলেও নিশ্চয়ই বাড়বে না। চুলায় কেতলি বসানো, পানি ফুটছে, চা বানানো কোনো ব্যাপার না। কথা হচ্ছে সে এখন যাবে না আরেকটু পরে যাবে? একটু পরে যাওয়াই বোধহয় ভালো। সময় যত যাবে রাগ তত কমবে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাগ বাড়তেও পারে। মীরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো।
নাও চা নাও।
শফিক হাত বাড়িয়ে চা নিল। মীরা বলল, গোসল করবে? বাথরুমে পানি আছে।
শফিক বলল, আরেকটু পরে।
চায়ে চিনি কম হয়েছে?
না চিনি ঠিক আছে।
আমি কি তোমার পাশে বসব?
বসতে চাইলে বসে। অনুমতি নেবার কী আছে?
তুমি যে চাকরি পেয়েছ–বাবা-মাকে খবরটা তো এখনো দাওনি। ওনারা খুব খুশি হবেন।
খুশি হবার কিছু নাই। খুশি যত কম হওয়া যায় ততই ভালো।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে রেগে আছ। পাশে বসার ভরসা পাচ্ছি না।
শফিক জবাব দিল না। মীরা পাশের চেয়ারে বসল। কথা বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। চুপচাপ বসে থাকাটাও ঠিক হচ্ছে না। মীরা বলল, আজ কি রকম গরম পড়েছে দেখেছ? কাল ছিল ঠাণ্ডা, চাদর গায়ে ঘুমাতে হয়েছে। আজ আবার গরম। তোমার অফিসে নিশ্চয়ই এসি আছে তাই না?
শফিক জবাব দিল না। মীরা বলল, ওরা যে বলেছে তোমাকে একটা মোবাইল টেলিফোন দেবে, কবে দেবে।
দিয়েছে।
মীরা আনন্দিত গলায় বলল, এই খবরটা দাওনি কেন? আচ্ছা এই মোবাইলে কি টিএন্ডটি লাইনও ধরা যায়? ধরা গেলে এক্ষুণি নিশোর সঙ্গে কথা বলতে পারি।
শফিক বলল, কথা বলতে চাইলে বলো।
মোবাইল রেখেছ কোথায়?
শার্টের পকেটে আছে।
এত বড় একটা খবর তুমি গোপন রেখেছ। আশ্চর্য!
মীরা ছুটে বের হয়ে গেল। নিশোর সঙ্গে কথা বলে এখন সে নিশোকে চমকে দেবে। কিছুক্ষণ আগে শফিক তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে এটা এখন আর মীরার মনে নেই।
হ্যালো কে? আমার নিশো মা?
হুঁ।
বলো তো আমি কে?
মা।
হয়েছে। কী করছ মা?
টিভি দেখছি।
কার্টুন?
হুঁ।
বলো তো কার টেলিফোনে টেলিফোন করছি?
জানি না।
তোমার বাবার টেলিফোন। তোমার বাবাকে অফিস থেকে দিয়েছে। তুমি কি বাবার সঙ্গে কথা বলবে?
না। আমি কার্টুন দেখব।
বাবার সঙ্গে কথা বলো। বাবা খুশি হবে।
আচ্ছা।
তুমি ধরে থাকো আমি টেলিফোনটা বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। টেলিফোনটা কানে দিয়ে রাখে। কান থেকে সরাবে না।
মীরা বালিকাদের মতো আনন্দিত ভঙ্গিতে বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়াল। শফিক কঁদছে। নিঃশব্দ কান্না না। শব্দ করে কাঁদছে। মীরা তার ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে এই দৃশ্য প্রথম দেখল।
শফিকের বাবা জয়নাল সাহেব
শফিকের বাবা নান্দিনা স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার জয়নাল সাহেবকে তাঁর ছাত্ররা ডাকত ডিকশনারি স্যার। কোনো বিচিত্র কারণে তিনি ইংরেজি ডিকশনারি মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। ক্লাসে ঢোকার সময় তার হাতে একটা ডিকশনারি থাকত। রোল কলের আগে ডিকশনারিটা কোনো একজনের দিকে বাড়িয়ে বলতেন— একটা কিছু ধর। দেখি আমি পারি কি না। কঠিন কোনো শব্দ খুঁজে বের করবি। এই খেলা কিছুক্ষণ চলার পর তিনি হষ্টচিত্তে রেল কল করতেন। যথারীতি ক্লাস শুরু হতো।
ডিকশনারি মুখস্থের পরীক্ষা তিনি শুধু যে ছাত্রদের দিতেন তা না, মাঝে মাঝে বিশিষ্টজনদের কাছেও দিতে হতো। স্কুল ইন্সপেকশনে একবার শিক্ষা অফিসার একরামুদ্দিন সাহেব এসেছিলেন। তিনি হঠাৎ জয়নাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনলাম আপনাকে সবাই ডিকশনারি স্যার ডাকে। সত্যি সত্যি ডিকশনারি মুখস্থ করে ফেলেছেন নাকি?
তিনি কিছু বললেন না। লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে থাকলেন। হেড মাস্টার সাহেব (বাৰু হরগোপাল রায়, এমএ বিটি গোল্ড মেডাল) বললেন, কথা সত্যি। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ডিকশনারি এনে দেই?
একরামুদ্দিন সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, ডিকশনারি লাগবে না। দেখি Canter শব্দের মানে বলুন।
জয়নাল সাহেব নিচু গলায় বললেন, Canter হলো ঘোড়ার চলা। খুব দ্রুতও না আবার খুব হালকা চালেও না। মাঝামাঝি।
হয়েছে। এখন বলুন Squint কী?
জয়নাল সাহেব অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, টেরা চোখ।
হয়েছে। Z দিয়ে একটা জিজ্ঞেস করি— Zither কী? স্যা
র এটা একটা বাদ্যযন্ত্র।
একরামুদ্দিন সাহেব আর কিছু বললেন না। গম্ভীর হয়ে গেলেন। স্কুল ইন্সপেকশন শেষ করে ঢাকায় ফিরে গেলেন। কিছুদিন পর জয়নাল সাহেব তার কাছ থেকে একটা পার্সেল পেলেন। সেখানে একটা চিঠি এবং চিঠির সঙ্গে চামড়ায় বাঁধাই করা একটা ডিকশনারি।