আপনার বলতে ইচ্ছা করলে বলুন।
মবিনুর রহমান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আমি তোমাকে কোনো গল্প বললে সেটা মনে করে রাখবে। আমি যদি কখনো শুনতে চাই শুনাবে।
জি আচ্ছা স্যার।
নিজের গল্প অন্যের কাছ থেকে শুনতে ভালো লাগে। ঠিক না?
জি স্যার ঠিক।
এই জন্যেই গল্প মনে রাখতে বলছি, অন্য কিছু না।
মবিনুর রহমান চেয়ারে পা তুলে গুছিয়ে বসলেন। বাবুলের দিকে তাকিয়ে গল্প শুরু করলেন।
সত্যজিৎ রায়ের একটা ছবি আছে না পথের পাঁচালী নাম। আমার বিয়ে হয়েছিল অবিকল পথের পাঁচালী স্টাইলে।
শফিক বিড়বিড় করে বলল, পথের পাঁচালী-তে কোনো বিয়ে কি হয়েছিল?
অবশ্যই হয়েছিল। নায়ক তার বন্ধুর সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে সেখানে বিয়ে হলো।
ছবিটার নাম স্যার অপুর সংসার। বিভূতিভূষণের কাহিনী।
কার কাহিনী বলতে পারব না। সত্যজিতের ছবি সেটা মনে আছে। টিভিতে দেখিয়েছিল। শফিক শোনো ছবির স্টাইলে আমার বিয়ে হয়।
শফিক চুপ করে রইল। তাঁকে মাথা ঘুরিয়ে গল্প শুনতে হচ্ছে। চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিলে ভালো হতো। সেটা করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না।
ছবিতে ছিল বন্ধুর মামাতো বোন কিংবা খালাতো বোন আর আমার বেলায় ছিল বন্ধুর আপন বোন। তবে ছবিতে বিয়ের পর ঘর-সংসার করে, আর আমার বেলায় রাত একটায় বিয়ে হয় পরদিন সকালে তালাক হয়ে যায়। খুবই ইন্টারেস্টিং স্টোরি। মেয়েটার নাম লায়লা। লায়লা একটা আরবি নাম। নামের অর্থ হলো রাত্রি। জানো নিশ্চয়ই?
জি স্যার জানি। আলিফ লায়লা—আরব্য রজনী।
আমার বিয়ের গল্পটাও আরব্য রজনী টাইপ। আমি গল্প-উপন্যাস লিখতে পারলে নিজেই একটা গল্প লিখে ফেলতাম। তোমার কি গল্প-টল্প লেখার অভ্যাস আছে?
জি না স্যার।
তোমার পরিচিত কোনো লেখক আছে? অন্যের প্লট নিয়ে গল্প লিখবেন? আমার কাছে অনেক গল্পের প্লট আছে।
আমার তেমন কেউ পরিচিত নেই স্যার।
অসুবিধা নাই। এখন পরিচয় নাই, ভবিষ্যতে হয়তো কারো সঙ্গে পরিচয় হবে তাই না?
জি স্যার।
তুমি নিজেও লিখে ফেলতে পারো। আমার স্ত্রীর নাম লায়লা। এটা লিখে রাখলে সুবিধা হবে, নাম ভুলবে না।
শফিক কিছু বলল না। বুড়োর কথাবার্তায় সে তেমন কোনো আগামাথা পাচ্ছে না।
বিয়ের গল্পটা তাহলে শোনো। বন্ধুর সঙ্গে তার গ্রামের বাড়িতে গেছি। বরযাত্রী আসবে ট্রেনে করে। বিকাল পাঁচটায় ট্রেন। বিকাল চারটা থেকে দলবুল নিয়ে স্টেশনে বসে আছি। ট্রেন এলো আধা ঘণ্টা লেট করে। আমরা স্টেশনে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। বর নামবে, ব্যান্ডপার্টি বাজনা শুরু করবে। বর নামল না। সত্যজিৎ বাবুর ছবির সাথে এইখানে একটু গণ্ডগোল। তাঁর ছবিতে বর এসেছিল নৌকায়।
স্যার নৌকায় না, পালকিতে।
ও আচ্ছা, মনে হয় পালকিতে। বর ছিল পাগল। আমার ক্ষেত্রে বর আসেইনি। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কান্নাকাটির কিছু ছিল না। মুসলমানি নিয়মে বিয়ের তারিখে বিয়ে না হলে কিছু যায়-আসে না। হিন্দু নিয়মে বোধহয় বিরাট সমস্যা হয়। লায়লার বাবা মহা হৈচৈ শুরু করলেন, আজকেই মেয়ের বিয়ে দেব। যদি আজ রাতের মধ্যে বিয়ে দিতে না পারি, তাহলে কাঁচা গু খাই। এই সব আজেবাজে কথা। গ্রামের মানুষরা তাল দিতে খুব ওস্তাদ। তারা তাল দিতে লাগল। রাত একটা দশ মিনিটে বিশ হাজার টাকা দেনমোহরে আমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।
টেনশনে আমার হয়ে গেল শরীর খারাপ। মাথা সোজা রাখতে পারি না। প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা। লায়লাদের কোনো এক আত্মীয় এর মধ্যে আমাকে দুই ডেজি হোমিওপ্যাথির কি ওষুধ খাওয়াল। শুরু হলো বমি। এক সময় মনে হলো মারাই যাব। ভোর রাতে মনে হলো শরীর সামান্য সুস্থ হয়েছে। গরম পানি দিয়ে গোসল করলাম। এক কাপ আদা-চা আর অর্ধেকটা বিকিট খেয়ে একটু ভাল বোধ করছি। তখন শুনি হৈচৈ-বরযাত্রী চলে এসেছে। ওরা ভুল করে দুই স্টেশন আগে নেমে গিয়েছিল, সেখান থেকে বাস ভাড়া করে এসেছে। কী রকম ঝামেলা হলো আন্দাজ করতে পারো?
জি স্যার পারছি।
কি হচ্ছে না হচ্ছে আমি অবশ্যি কিছুই জানি না। আমি বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে সারাক্ষণ শুয়েছিলাম। এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে আমার বন্ধু এসে আমাকে ডেকে তুলল, নানা কথা, নানা ধানাইপানাই। মূল বিষয় বিয়ে শুধু কাগজপত্রে হয়েছে। ম্যারেজ কনজুমেট হয়নি। এই বিয়ে ভেঙে দেয়া নাকি কোনো ব্যাপার না। ঐ পার্টি তাই চায়। এইসব হাবিজাবি কথা।
তারাই কাজি ডেকে আনল। তালাক হয়ে গেল। তালাক হয়ে গেল সকাল আটটা দশে। এইখানে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ্য করো। বিয়ে হয়েছিলো একটা দশে। তালাক হবার পর ঘড়ি দেখলাম তখন বাজে আটটা দশ। আটটা দশ না হয়ে আটটা পনের কিংবা বিশও হতে পারত। তা কিন্তু হয়নি। দশ মিনিট একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক বলেছি কিনা বলো?
জি স্যার।
এরপর থেকেই সময়ের ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইম্পর্টেন্ট হয়ে গেছে। তোমাকে এই কারণেই বারবার কয়টা বাজে জিজ্ঞেস করি। আমার বিয়ের গল্পটা কেমন লাগল?
ভালো।
কোন তারিখে বিয়ে হয়েছিল এটা তোমাকে বলতে পারছি না। তারিখটা মনে নেই। মনে অবশ্যই পড়বে, তখন তোমাকে বলব। তুমি খাতায় নোট করে রেখো।
জি স্যার রাখব।
লায়লা এখন নারায়ণগঞ্জে থাকে। একটাই মেয়ে। মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়েছে। তবে এখনো বিয়ে হয়নি। আমার সঙ্গে অবশ্যি তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে আমি খোঁজখবর রাখি। মাঝে মধ্যে এটা সেটা উপহার পাঠাই। গত বছর এক ঝুড়ি গোপালভোগ আম পাঠিয়েছিলাম। তোমার আগে যে ম্যানেজার ছিল সে নিয়ে গিয়েছিল। তার কাছে শুনেছি তারা তাকে যত্ন করেছে। চা-কেক খাইয়েছে। লায়লা আমার সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। শরীর কেমন কি। এইসব। ভাবছি এই বছরও কিছু আম পাঠাব। তুমি দিয়ে আসবে। পারবে না?