- বইয়ের নামঃ সেদিন চৈত্রমাস
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
বাড়ির নাম আতর-বাড়ি।
ঢাকা শহরে অদ্ভুত অদ্ভুত নামের অনেক বাড়ি আছে। আতর-বাড়িকে কি সেই তালিকায় ফেলা যায়?
গাছপালায় ঘেরা বিশাল দোতলা বাড়ি। চারিদিকে উঁচু পাঁচিল বলে দিচ্ছে বাড়ির মালিকের প্রচুর পয়সা। ধনবান ব্যক্তিদের বাড়ির পাঁচিল উঁচু হয়। তাঁরা নিজেদের পাঁচিল দিয়ে আলাদা করে রাখতে পছন্দ করেন। তাদের বাড়ির গেট হয় নিচ্ছিদ্র লোহার। সেখানে কোন ফুটো-ফাটা থাকে না। ফুটোর ভেতর দিয়ে তাদের বাড়ির ভেতরের কোন কিছুই দেখার উপায় নেই।
শফিকুল করিম আতর-বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছা করলেই সে বাড়িতে ঢুকতে পারে। ঢুকছে না। সিগারেট ধরিয়েছে, কে জানে ভেতরে হয়তো সিগারেট খাওয়া যাবে না। এমন হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে বাড়ির মালিক মবিনুর রহমান সিগারেটের ধোঁয়া পছন্দ করেন না। অতি ধনবানরা একটা পর্যায়ে এসে ডাক্তারদের নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। সিগারেট ছেড়ে দেন। নিরামিশি হয়ে যান। সকালে মর্নিং ওয়াক করেন। বাড়িতে ওয়াকার নামক যন্ত্র থাকে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁটা। ধনবানদের জন্যে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
একটা সিগারেট শেষ করতে শফিকুল করিমের দুই মিনিট বার সেকেন্ড লাগে। স্টপওয়াচ দিয়ে হিসাব করা। আজকে মনে হয় সময় বেশি লাগছে। টেনশনের সময় অন্য সবাই সিগারেট দ্রুত টানে। তার বেলায় উল্টোটা হয়— সে সিগারেট আস্তে টানে। সময় বেড়ে যায়। শফিকুল করিমের কাছে মনে হচ্ছে সে দশ-পনেরো মিনিট ধরেই সিগারেট টানছে, তারপরও অর্ধেকের বেশি শেষ হয়নি। মনে হয় তার টেনশন বেশি হচ্ছে। অথচ টেনশনের কোনোই কারণ নেই। মবিনুর রহমান তাকে চাকরি দিয়েছেন। আজ সে জয়েন করবে।
কি ধরনের চাকরি সে বুঝতে পারছে না। ওনার পিএ টাইপ কিছু? নাকি বাজার সর্দার? প্রতিদিন সকালে গাড়ি ভর্তি বাজার আনতে হবে। চাকরির শর্তে কিছুই বলা নেই। বেতনের অংকটা লেখা আছে মাসে বার হাজার এবং অন্যান্য সুবিধা। অন্যান্য সুবিধা কি কে জানে।
একেক কাজে একেক ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। পত্রিকা অফিসে যখন কাজ করত তখন অন্যান্য সুবিধার মধ্যে ছিল ফ্রি চা। বেতনের কোনো ঠিকঠিকানা নেই; কিন্তু যখন ইচ্ছা তখন চা খাওয়া। রঙ চা, দুধ চা, মাঝে মধ্যে মালাই চা বলে এক বস্তু। দুধের সর দিয়ে বানানো।
সে কিছুদিন ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেছে। সেখানের সুবিধা বিনা টিকিটে বিমান ভ্রমণ
এন্টার্কটিকা ট্রাভেলস-এর মালিক বজলুল আলম চাকরি দেয়ার সময় শফিকুল করিমের পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন—বিনা টিকেটে দেশ-বিদেশ ঘুরবেন। যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাবেন। জাপান-ইউরোপ-আমেরিকা কোনো ব্যাপারই না। অফ সিজনে যাবেন, এয়ারলাইন্স ফ্রি বিজনেস ক্লাসের টিকেট দেবে। আত্মীয়স্বজন বিদেশ যাচ্ছে? টেলিফোন করে বলে দেবেন তাদের নরমাল ইকোনমি ক্লাস টিকেট হয়ে যাবে বিজনেস ক্লাস। পায়ের ওপর পা তুলে ভ্রমণ।
শফিকুল করিমের জীবনে একবারই ফ্রি টিকেট জুটেছিল। ঢাকা-কাঠমন্ডু ঢাকা। কাঠমন্ডু যাওয়া হয়নি, তার আগেই চাকরি চলে গেল। এন্টার্কটিকা ট্রাভেলস-এর মালিক বজলুল আলম তার পিঠে হাত রেখে বললেন, সরি ভাই। আপনাকে দিয়ে আমাদের পোযাচ্ছে না। আমাদের আরো স্মার্ট লোক দরকার। আপনি একটু স্লো আছেন।
বজলুল আলমের অভ্যাস ছিল পিঠে হাত রেখে কথা বলা। বস শ্রেণীর মানুষদের কথা বলার অনেক প্যাটার্ন আছে। কেউ কথা বলে পিঠে হাত রেখে। কেউ কথা বলে চোখের দিকে না তাকিয়ে (প্রাইড পত্রিকার সম্পাদক হাসনাইন খান) আবার কেউ কথাই বলে না। যেমন বেগম রোকেয়া গার্লস কলেজের প্রিন্সিপাল আব্দুল মুকিত খান। শফিকুল করিম সেই কলেজে এক বছর এগারো মাস কাজ করেছে। বেতন ভালো ছিল না তবে মাসের সাত তারিখের মধ্যেই পাওয়া যেত। দুই ঈদে বোনাস ছিল। হুট করে চাকরি চলে গেল। প্রিন্সিপাল আব্দুল মুকিত খান সাহেব কম্পিউটার টাইপ করা চিঠিতে জানালেন– কলেজ পরিচালনা পরিষদ আপনার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি একশান নিয়েছে। শফিকুল করিম কি ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছে সেটা জানার জন্যে আধঘণ্টা প্রিন্সিপাল সাহেবের ঘরে বসে রইল। তিনি কোনো কথা বললেন না। এই আধঘণ্টা তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে নাকের লোম ছিঁড়ে টেবিলের ওপর রাখা এ ফোর সাইজ কাগজে জমা করতে লাগলেন। যেন তিনি নাকের লোম দিয়ে মহৎ কোনো শিল্পকর্ম করছেন। শিল্প-সৃষ্টিতে তিনি নিমগ্ন। এই সময়ে কারো দিকে তাকানো যাবে না এবং কারোর কথার কোনো জবাব দেয়া যাবে না।
আতর-বাড়ির মালিক মবিনুর রহমান সাহেবের নিয়ম-কানুন কী কে জানে! নিয়ম-কানুন নিশ্চয়ই আছে। থাকতেই হবে। হয়তো কথা বলার সময় তাঁর মুখ দিয়ে থুথু বের হয়। এই থুথু হাসি মুখে গায়ে মাখতে হবে। শফিকুল করিম সিগারেট ফেলে দিয়ে গেটের কলিং বেল টিপল। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বাড়ির গেটের কলিং বেল কাজ করে না। বেল টেপার পরপরই অনেকক্ষণ গেটে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়। এই বাড়িরটা কাজ করছে। দুবার বেল টিপতেই গেট খুলে গেল। দারোয়ান গলা বের করে বলল, কারে চান?
দারোয়ানকে দেখে স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে। সে লুঙ্গির ওপর খাকি শার্ট পরেছে। তার মানে আতর-বাড়ি ঢিলাঢালা অবস্থায় চলে। নিয়ম-কানুন কঠিন না। কঠিন নিয়ম হলে খাকি শার্ট-প্যান্ট, বুট-জুতা সবই থাকত। মুখও হাসি হাসি থাকত। তাদের মুখ দেখে মনে হতো কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা যুদ্ধে রওনা হবে।