লিলি বলল, ছোট চাচা তুমি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে?
জাহেদুর রহমান পা নাচাতে নাচাতে বলল, ফর গুড দিতে পারব না। ধার হিসেবে দিতে পারি।
ধার হিসেবেই দাও।
কত?
পাঁচ শ।
এত টাকা দিয়ে করবি কী? পাঁচ শ তো অনেক টাকা। প্রায় পনেরো ডলার। পনেরো ডলার দিয়ে তুই করবি?
রিকশায় করে শহরে চক্কর দেব। ঘুরব। একদিনের জন্য হিমু হয়ে যাব। মহিলা হিমু।
হিমুটা কে?
তুমি চিনবে না। দিতে পারবে পাঁচ শ টাকা?
তিন শ দিতে পারব। বাকি দুশ অন্যখান থেকে ম্যানেজ কর। ভাইজানকে গিয়ে বল ইউনিভার্সিটিতে পিকনিক হচ্ছে, দুশ টাকা চাঁদা।
মিথ্যা কথা বলতে পারব না।
মিথ্যা কথাটা তুই এত ছোট করে দেখিস কেন লিলি। মিথ্যা আছে বলেই জগতসংসার এত সুন্দর। গাদা-গাদা গল্প উপন্যাস যে পড়িস সবই তো মিথ্যা। লেখকেরা সত্যি কথা লেখা শুরু করলে বই আর পড়তে হতো না। মিথ্যা কথা বলা না শিখলে লাইফ হেল হয়ে যাবে।
লিলি হেসে ফেলল। জাহেদুর রহমান গম্ভীর গলায় বলল, হাসিস না। আমি হাসির কোনো কথা বলছি না। সত্যি কথা হলো ডিস্টিল ওয়াটারের মতো টেস্টলেস। আয় আমার সঙ্গে, টাকা নিয়ে যা।
কত দেবে, তিন শ?
পাঁচ শ দেব। তোকে খুব পছন্দ করি। এইজন্যই দিচ্ছি। তুই হচ্ছিস অনেস্ট একটা মেয়ে।
লিলি হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে আমাকে পছন্দ করো তার কারণ হলো আমি সব সময় সত্যি কথা বলি। আমি যদি তোমার মতো মিথ্যা বলতাম তাহলে পছন্দ করতে না। কাজেই সত্যি বলার কিছু এ্যাডভানটেজ আছে।
জাহেদুর রহমান চিলেকোঠায় থাকে। তার ঘর ছবির মতো সাজানো। খাটে টানটান করে চাদর বিছানো। টেবিলের বইগুলো সুন্দর করে সাজানো। কোথাও এক কণা ধুলা নেই। জুতা বা স্যান্ডেল পরে তার ঘরে ঢোকা যাবে না। বাইরে খুলে ঢুকতে হবে। লিলি বলল, ঘরে ঢুকব না ছোট চাচা। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি তুমি দিয়ে দাও।
আয়, একটু বসে যা।
লিলি স্যান্ডেল খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তোমার আমেরিকা যাবার কিছু হয়েছে?
নতুন একটা লাইন ধরেছি। ভালো লাইন। হয়ে যেতে পারে।
কী লাইন?
আমেরিকান এক মরমন পাদ্রির সঙ্গে খাতির জমিয়েছি। প্রতি রোববারে যাই। এমন ভাব করি যেন যিশুখ্রিস্টের অমর বাণী শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। তাকে পটাচ্ছি। সে ভাবছে সে আমাকে পটাচ্ছে।
তাকে পটিয়ে লাভ কী?
এক স্টেজে খ্রিস্টান হয়ে যাব। তারপর তাকে বলব–আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা এখন আমাকে মেরে ফেলার জন্য ঘুরছে। আমাকে বাঁচাও। আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও। পলিটিক্যাল এসাইলেমের ব্যবস্থা করো। বুদ্ধিটা তোর কাছে কেমন লাগছে?
লিলি জবাব দিল না। জাহেদুর রহমান ড্রয়ার থেকে টাকা বের করতে করতে বলল, অনেক চিন্তাভাবনা করে এগুচ্ছি। এইবার একটা-কিছু হবেই।
যদি না হয় কী করবে?
আরও দুবছর দেখব। এই দুবছরে না হলে, আশা ছেড়ে দিয়ে বিয়ে-শাদি করব। ফেইথফুলি সংসার করব। টু বাংলাদেশী হয়ে যাব। পয়েলা বৈশাখে রমনা বটমূলে যাব। গব-গব করে পান্তাভাত খাব।
আমেরিকা যাবে এই জন্যই বিয়ে করছ না?
অবশ্যই। একজনেরই ব্যবস্থা হয় না দুজনের কীভাবে হবে? আমি ভিসা পেয়ে চলে গেলাম তোর চাচি দেশে পড়ে রইল, চোখের জল নাকের জল ক্রমাগত মিক্স করে যাচ্ছে। তখন অবস্থাটা কি হবে? নে, টাকা গুনে নে।
পাঁচ শ টাকার নোট গুনে নেব কি?
ভুলে দুটি চলে গেল কিনা দেখ। আর শোন লিলি, এই টাকা তোকে ফেরত দিতে হবে না। টাকাটা তোকে আমি উপহার হিসেবে দিলাম।
কেন?”
এমনি দিলাম। তুই হচ্ছিস একজন সত্যবাদী মহিলা…
আজ সকাল থেকেই লিলির মন খারাপ হয়েছিল। এখন মন ভালো হতে শুরু করল। ছোট চাচার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই তার মন ভালো হয়।
জাহেদুর রহমান একটু ঝুঁকে এসে বলল, টাকাটা তোকে যে শুধু শুধু দিয়ে * দিয়েছি তা না। এর বদলে তোকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
আমার যেন কিছু ব্যবস্থা হয় সেই দোয়া করবি। সত্যবাদী মহিলার দোয়া আল্লাহ শুনবেন।
আচ্ছা যাও, দোয়া করব।
আল্লাহকে বলবি এই যে খ্রিস্টান হচ্ছি এটা আমার একটা ট্রিকস। উনি যেন এটাকে আবার সিরিয়াসলি না নেন।
লিলি হাসছে। শব্দ করে হাসছে।
জাহেদুর রহমান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, গুড গার্ল। চল, নাশতা খেয়ে আসি।
নাশতার টেবিলে দারুণ হইচই হচ্ছে। নেয়ামত সাহেব ভাজির বাটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে ভেঙেছেন। এখন বিকট চিৎকার করছেন। ঐ বেটির মুখে এক পোয়া লবণ ঢুকিয়ে দাও। তাহলে যদি শিক্ষা হয়।
মতির মা ভাঙা বাটির টুকরা কুড়াচ্ছে। ফরিদা নতুন করে ভাজি বসিয়েছেন।
লিলি রান্নাঘরে মার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, বাবা এ-রকম বিশ্রী করে চেঁচাচ্ছে কেন মা?
ফরিদা বললেন, পুরুষ মানুষ একটু চেঁচামেচি তো করবেই। পুরুষদের সবকিছু ধরতে নেই। লবণটা একটু দেখ তো মা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভয়ের চোটে দুবার লবণ দিয়ে ফেলেছি।
লিলি সামান্য ভাজি মুখে নিয়ে বলল, দুবার না মা, তুমি তিনবার লবণ দিয়েছ।–বলতে বলতে লিলি হাসল। লিলির হাসি দেখে ফরিদা হাসলেন। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, তুই তো দারুণ সুন্দর হয়েছিস লিলি। কী আশ্চর্য কাণ্ড! আমি তো লক্ষই করি নি। তুই কি সকালে গোসল করেছিস?
হা।
তোর বয়েসী মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর দেখা যায় গোসলের পরপর। এত সকালে গোসল করলি কেন?