বড় চাচা সম্পর্কে দাদিজানের এই কথাগুলো লিলির সত্যি মনে হয়। বড় চাচার কারণে লিলিরা দ্রুত পথে বসতে বসেছে। এই সত্য স্বীকার করা ছাড়া এখন আর পথ নেই। বিষয়-সম্পত্তি সব দেখার দায়িত্ব তার। তাকেই পাওয়ার অব এ্যাটর্নি করে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি একে-একে সব বিক্রি করছেন। অন্য দুই ভাই এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। সংসার ঠিকমতো চলছে, খাওয়া-দাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে না, কাজেই অসুবিধা কী? অসুবিধা হোক, তারপর দেখা যাবে। তা ছাড়া মুনশি ইরফানুদ্দিন খাঁ মৃত্যুর সময় বলে গেছেন ভাইয়ে ভাইয়ে মিল-মহব্বত রাখবা। পিতৃ আজ্ঞার অন্যথা হয় নি। ভাইয়ে ভাইয়ে মিল মহব্বত আছে। ভালোই আছে।
এই বাড়ি হলো অসুবিধাহীন বাড়ি। এ বাড়িতে কারও অসুবিধা হয় না। সবাই ভালো থাকে। সুখে থাকে। কারও অসুখ হলে ডাক্তার চলে আসে। বাসায় এসে রোগী দেখে যায়। ডাক্তার হলো বড় চাচার বন্ধু সামছুদ্দিন তালুকদার হোমিওপ্যাথ। এক সপ্তাহ তার চিকিৎসা চলে। এক সপ্তাহে কিছু না হলে অন্য ডাক্তার রমজান আলী, এলোপ্যাথ।
লিলির বড় চাচার নিয়মে হোমিওপ্যাথির জন্য এক সপ্তাহ দিতে হবে। এক সপ্তাহে রোগ যত প্রবলই হোক অন্য চিকিৎসা হবে না। সাত দিন সময় না দিলে বুঝা যাবে কেন ওষুধ কাজ করছে না। এলোপ্যাথি হলো বিষ-চিকিৎসা। যত কম করানো যায়।
তবে আজাহার উদ্দিন খাঁ অবিবেচক নন। পরিবারের সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা তিনি দেখেন। লিলির দিকে তাকিয়ে তিনি গাড়ি কিনলেন। সেই গাড়ি কেনার ইতিহাস হচ্ছে–লিলি একবার রিকশা করে আসার সময় রিকশা উল্টে পড়ে গেল। হাত কেটে রক্তারক্তি। হাসপাতাল থেকে সেলাই করিয়ে আনার পর আজহার উদ্দিন খ বললেন, রিকশা নিরাপদ না। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের যাতায়াতের জন্য গাড়ি দরকার। টু ডোর কার, যাতে পেছনের দরজা হঠাৎ খুলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকে।
আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো, একটা টু ডোর কার এবং একজন বুড়ো ড্রাইভার। স্ত্রী যেমন যত বুড়ি হয় তত ভালো হয়, ড্রাইভারও তেমন। যত বুড়ো ততই অভিজ্ঞ।
এক সপ্তাহের মধ্যে লিলিদের গাড়ি চলে এলো। ফোক্সওয়াগন। রাস্তার সঙ্গে মিশে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চলে। গাড়িতে ঢুকতেও হয় প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। গাড়ির ড্রাইভারও দর্শনীয়, জহির-বুড়ো। এক চোখে ছানি পড়া, অন্য চোখেও ঝাপসা দেখে। সামনে কিছু পড়লে হর্ন দেয় না। জানালা দিয়ে মুখ বের করে অতি ভদ্র এবং অতিশালীন ভাষায় গালি দেয়–ঐ রিকশা। গাড়ি আসতেছে শব্দ শুনো না? নড়ো না কেন? গজব পরবো। বুঝলা, গজব!
লিলি যদি বলে, আপনি হর্ন দেন না কেন ড্রাইভার চাচা? হর্ন দিতে অসুবিধা আছে?
ড্রাইভার উদাস গলায় বলে, অসুবিধা আছে গো মা। ব্যাটারির যে অবস্থা হর্ন দিলে ব্যাটারি বসে যাবে। গাড়ি চলবে না। ব্যাটারির কারেন্টের বারো আনাই চলে যায় হর্নে। মানবজাতির দিকে তাকিয়ে দেখো মা, যে যত কথা বলে তত আগে তার মৃত্যু। কথা বলে বলে কারেন্ট শেষ করে ফেলে।
দার্শনিক ধরনের উক্তি। লিলির বলতে ইচ্ছে করে আপনি যে হারে কথা বলেন তাতে আপনার কারেন্ট ছেলেবেলাতেই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। শেষ তো হয় নি। যত বুড়ো হচ্ছেন কারেন্ট তত বাড়ছে।
কঠিন কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলেও লিলি শেষ পর্যন্ত কিছুই বলে না। তার কাউকে কিছু বলতে ভালো লাগে না। তাদের এই বিচিত্র সংসারে বড় হয়ে আজ তার এই সমস্যা হয়েছে। সব সময় মনে হয় হোক যা ইচ্ছা, ড্রাইভার সারাক্ষণ কথা বলে বলুক। কারেন্ট খরচ করুক।
লিলি কিছুক্ষণ দোতলার টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেল। আজ কী বার মনে করতে পারল না। আজ কি তার ইউনিভার্সিটি আছে? সে কি কোনো বিশেষ কারণে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে? হঠাৎ মনে হলো মাস্টার সাহেব রুমু ঝুমুকে সকালে পড়াতে এসেছেন, কাজেই আজ শুক্রবার। একমাত্র শুক্রবারই তিনি সকালে আসেন। ইউনিভার্সিটিতে কোনো ক্লাস নেই। লাইব্রেরিতে গিয়ে নোট করার কথাও নেই। আজ কোথাও যাওয়া যাবে না।
লিলি আবার একতলায় নেমে এলো। কোথাও তার যেতে ইচ্ছে করছে। কোথায় যাওয়া যায়?
টেবিলে নাশতা সাজানো হচ্ছে। গাদাখানিক রুটি ভাজি। বড় এক বাটি পেঁপের হালুয়া। দিনের পর দিন একটাই নাশতা। এই নিয়েও কারও বিকার নেই। একদিন একটু অন্য কিছু করলে হয়। লিলি ভাজি মুখে না দিয়েই বলে ভাজিতে লবণ বেশি হয়েছে। মতির মা বুয়া লবণ বেশি না দিয়ে ভাজি করতে পারে না। লবণ বেশি দেবে, বকা খাবে। মতির মা ধরেই নিয়েছে ভাজি নিয়ে বকাঝকা দিন শুরুর অংশ।
লিলির ছোট চাচা জাহেদুর রহমান লিলিকে দেখেই আনন্দিত গলায় বলল, হারামজাদার নাকে এক ঘুসি দিয়েছি, গলগল করে ব্লাড বের হয়ে এসেছে।
কার নাকে ঘুসি দিলে?
দুধওয়ালার নাকে। আমার সঙ্গে তর্ক করে। অন্যায় করেছ ক্ষমা চাও। ক্ষমা করে দেব। ক্ষমা মানবধর্ম। তা না, তর্ক। হারামজাদার সাহস কত। রগে রগে সাহস। সাহস বের করে দিয়েছি।
সত্যি সত্যি মেরেছ?
অবশ্যই মেরেছি। গদাম করে ঘুসি। হারামজাদা, তুমি মানুষ চেনো না। রোজ তেলাপোকা খাওয়াও…।
দুধওয়ালার নাক ভেঙে দিয়ে জাহেদুর রহমানকে অত্যন্ত উৎফুল্ল লাগছে। জাহেদুর রহমানের বয়স পঁয়ত্রিশের উপর কিন্তু চলাফেরা হাবভাব আঠারো উনিশ বছরের তরুণের মতো। সব সময় সেজেগুজে থাকে। প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করা। চকচকে জুতা। রঙচঙে শার্টের কলারের নিচে সোনার চেন ঝকঝক করে। জাহেদুর রহমান গত সাত বছর ধরে ইমিগ্রেশন নিয়ে আমেরিকা যাবার চেষ্টা করছে। তার অধ্যবসায় দেখার মতো। লিলির ধারণা তার ছোট চাচা যদি আমেরিকা যাবার জন্য এখন পর্যন্ত কি কি করেছে তার একটা তালিকা করে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে পাঠায় তাহলে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন তাকে সিটিজেনশিপ দিয়ে সম্মানের সঙ্গে আমেরিকা নিয়ে যাবেন।