তাদের বর্তমান বাড়ি লিলির দাদাজান ইরফানুদ্দিন খাঁর বানানো। বাড়ি যেমন কুৎসিত, বাড়ির নামও কুৎসিত। রহিমা কুটির রহিমা তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম।
লিলির ধারণা তার দাদাজান সবার একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে বেহেশত কিংবা দোজখ কোনো এক জায়গায় চলে গেছেন। দোজখ হবার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি ছিলেন ইনকামট্যাক্স অফিসের হেড ক্লার্ক। এই চাকরি থেকে করেন নি হেন জিনিস নেই।
কয়েকটা বাড়ি বানালেন। ট্রাক কিনলেন, বাস কিনলেন। পঞ্চাশ বছর বয়সে আবার বিয়ে করলেন। চৌদ্দ বছর বয়সের এক খুকি।
তাঁর একটা হিন্দু কাজের মেয়ে ছিল। রেবতী। একদিন দেখা গেল তার নামেও কলতাবাজারের বাড়িটা লিখে দিলেন। সেই খুকির নামে বাড়ি লিখে দিলেন। দরাজ গলায় বললেন, এর আত্মীয়স্বজন সব ইন্ডিয়া চলে পেছে–এ যাবে কোথায়? খাবে কী? জীবনে সৎ কাজ তো কিছু করি নাই। একটা করলাম আর কি! ক্ষুদ্র একটি সৎ কর্ম। হা হা হা।
এসব ঘটনা লিলি দেখে নি, শুনেছে। দাদাজান যখন মারা যান তখন লিলি ক্লাস সিক্সে পড়ে। পরদিন ভূগোল পরীক্ষা, দরজা বন্ধ করে পড়ছে। বাবা এসে ডেকে নিয়ে গেলেন। তখন দাদাজানের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে নিশ্বাস স্বাভাবিক হয় তখন কথা বলেন। সব কথাবার্তাই কিভাবে আরও কিছুক্ষণ বেঁচে থাকা যায় সেই বিষয়ে…
খাঁটি মৃগনাভি পাওয়া যায় কি-না দেখ। মৃগনাভি মধুর সঙ্গে বেটে খাওয়ালে জীবনী শক্তি বাড়ে।
মৃগনাভির সন্ধানে হেকিমী ওষুধের দোকানে লোক গেল। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, রাতটা কোনো রকমে পার করে দিতে পারলে আর চিন্তা নাই। আজরাইল কখনও দিনে জান কবজ করে না। আজরাইল জান কবজ করে রাতে।
তিনি রাতটা টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। আশা ছেড়ে দিলেন। ততক্ষণে মৃগনাভি পাওয়া গেছে। মরা মানুষের শুকনা চামড়ার মতো এক টুকরা চামড়া যার মধ্যে লোম লেগে আছে। মৃগনাভি থেকে কড়া অডিকোলনের মতো গন্ধ আসছে। তিনি বললেন, মৃগনাভি রেখে দে, লাগবে না। কোরান মজিদ নিয়ে আয়।
কোরান শরিফ আনা হলো। তিনি তার ছেলেদের বললেন কোরান মজিদে হাত রেখে তোমরা প্রতিজ্ঞা করো ভাইয়ে ভাইয়ে মিল মহব্বত রাখবে। তিন ভাই এক বাড়িতে থাকবে এবং আমার মৃত্যুর কারণে বেকুবের মতো চিৎকার করে কাঁদবে না। তিন ভাই মিলে তখনই কান্নাকাটি শুরু করল। হইচই এবং ঝামেলায় এক ফাঁকে আজরাইল টুক করে জান কবজ করে ফেলল।
লিলি তার বাপ-চাচার মতো পিতৃভক্ত মানুষ এখনও দেখে নি। কী অসীম শ্রদ্ধা ভক্তি। বিরাট এক অয়েল পেইন্টিং বসার ঘরে লাগানো। সবার ঘরের যাবতীয় আসবাবে ধুলা জমে আছে কিন্তু পেইন্টিংয়ে ধুলা নেই। সব সময় ঝকঝক করছে। পেইন্টিং দেখলে যে-কেউ বলবে–পুরনো দিনের কোনো ছোটখাটো শুকনো মহারাজ। যার প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা বলে মুখ আপাতত বিকৃত।
নেয়ামত সাহেব তার ছেলেমেয়ের জন্ম তারিখ জানেন না। নিজের বিয়ের তারিখ জানেন না। অথচ তার বাবা মুনশি ইরফানুদ্দিন খাঁ সাহেবের মৃত্যু তারিখ ঠিকই জানেন। ঐ দিন বাড়িতে বাদ আছর মিলাদ হয়। রাতে গরিব-মিসকিন খাওয়ানো হয়। এতিমখানায় খাসি দেয়া হয়। নেয়ামত সাহেব পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে অনেক রাত পর্যন্ত কোরান পাঠ করেন। রাতে খেতে বসে ঘনঘন বলেন গ্রেটম্যান ছিলেন, কর্মযোগী পুরুষ। এ-রকম মানুষ হয় না। কী দরাজ দিল! কী বুদ্ধি! ওহ ওহ…। বাবার সদ্গুণের কিছুই পেলাম না। বড়ই আফসোস।
পিতৃভক্ত ছেলেদের মুখে মায়ের নাম তেমন শোনা যায় না। মার মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় না। কেন হয় না লিলি জানে না। লিলি এ মহিলাকে খুব ছোটবেলায় দেখেছে সেই স্মৃতি তার মনে পড়ে না। দুনম্বর দাদিজানি বেঁচে আছেন। তাঁর কোনো ছেলেপুলে হয় নি। তিনি তার ভাইদের সঙ্গে আলাদা থাকেন। যদিও কাগজপত্রে লিলিরা যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়িটা তাঁর।
এই মহিলার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হলেো চেহারায় খুকি খুকি ভাব আছে। স্বামীর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে তিনি লিলিদের বাড়িতে আসেন। তাঁকেও ভালোই খাতির-যত্ন করা হয়। লিলির কাছে খুব আশ্চর্য লাগে, এই মহিলাও দারুণ স্বামীভক্ত। লিলিকে ফিসফিস করে বলেন, অসাধারণ একটা মানুষ ছিলরে লিলি। অসাধারণ।
কোনদিক দিয়ে অসাধারণ?
সব দিক দিয়ে।
কাজের মেয়েকে বাড়ি লিখে দিলেন তারপরও অসাধারণ?
লিখে দিয়েছে বলেই তো অসাধারণ। কাজের মেয়ের সঙ্গে কতজন কতকিছু করে। কে আর বাড়িঘর লিখে দেয়।
আপনার এইসব ভেবে অস্বস্তি লাগে না?
মেয়েদের এত অস্বস্তি লাগলে চলে না। পুরুষ মানুষ এ-রকম হয়ই। আদরে আদরে ছোঁক ছোঁক স্বভাব হয়। দোষটা স্বভাবের মানুষের না।
কী যে আপনি বলেন দাদিজান! মানুষ আর তার স্বভাব বুঝি আলাদা?
অবশ্যি আলাদা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এইসব বুঝবি না। এইসব তো আর ইউনিভার্সিটিতে শেখায় না। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবি। সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তুই তোর দাদাজানের বুদ্ধি খানিকটা পেয়েছিস, তুই বুঝতে পারবি। তোর বাপ-চাচার কেউ তার বুদ্ধি পায় নি। সব কটা ছাগল মার্কা হয়েছে। বুদ্ধি-শুদ্ধি, চলাফেরা, কাজকর্ম সবই ছাগলের মতো। সবচেয়ে বড় ছাগল হচ্ছে তোর বড় চাচা। জ্ঞানী ছাগল। ওর পাশ দিয়ে গেলে ছাগলের বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যায়।