যন্ত্রণা করছি না মা। দুধটা তুমি কী করেছ বলো? ফেলে দিয়েছ?
না।
তাহলে কী করেছ?”
বুয়ারা খেয়ে ফেলেছে।
তিন লিটার দুধ দুজনে মিলে খেয়ে ফেলেছে?
ফরিদা এবার চোখ-মুখ করুণ করে বললেন, তোর বাবা চা খাবে কি-না। জিজ্ঞেস করে আয়। লক্ষ্মী মা।
লিলি বাবার ঘরের দিকে রওনা হলো। তিনিও দোতলায় থাকেন। তবে তাঁর ঘর বড় চাচার ঘরের উল্টো দিকে। আবারও বড় চাচার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই, তবে সিঁড়ি দিয়ে খুব সাবধানে উঠতে হবে। বড় চাচা পায়ের শব্দও চেনেন। পায়ের শব্দ শুনেই ডেকে বসতে পারেন, যাচ্ছে কে লিলি না? একটু শুনে যা মা।
লিলির বাবা নেয়ামত সাহেব জেগে আছেন। খালি গা, লুঙ্গি হাঁটুর উপর উঠে এসেছে। মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখের নিচে কালি। দুচোখের নিচে না, এক চোখের নিচে। মানুষের দুচোখের নিচে কালি পড়ে। তাঁর কালি পড়ে শুধু ডান চোখের নিচে। তাঁর বোধহয় একটা চোখ বেশি ক্লান্ত হয়। কেমন অসুস্থ অসুস্থ চেহারা।
চা খাবে বাবা?
নেয়ামত সাহেব চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, হাত-মুখ কিছু ধুই নি, চা খাব কি? সব সময় ইডিয়টের মতো কথা।
মা জানতে চাচ্ছিল চা খাবে কি-না।
খবরের কাগজ দিয়ে যা।
কাগজ এখনও আসে নি।
নটা বাজে এখনও কাগজ আসে নি? হারামজাদা হকারকে ধরে মার লাগানো দরকার। শুয়োরের বাচ্চা…
লিলি বাবার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। কী বিশ্রী পরিবেশ চারদিকে! কোনো আনন্দ নেই। একটা হট্টগোলের বাড়ি। যে বাড়িতে কিছুক্ষণ থাকলেই মাথা ধরে যায়। যে বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ বাস করে কিন্তু কারও সঙ্গেই কারও যোগ নেই। যে বাড়ির মানুষগুলো সুন্দর করে, ভদ্র করে কথা বলা কী জানে না।
একতলায় ভেতরের বারান্দায় রুমু ঝুমুর স্যার তার ছাত্রীদের নিয়ে বসেছেন। দুজনেই ক্লাস এইটে পড়ে। এবার নাইনে পড়ার কথা ছিল। একসঙ্গে ফেল করায় এইটে। প্রাইভেট মাস্টারের ব্যবস্থা করে রুমু ঝুমুর প্রতি দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। এই প্রাইভেট মাস্টার না-কি দারুণ ভালো। গেরেন্টি দিয়ে পড়ায়। একটা বেতের চেয়ারকে সে যদি তিন মাস একনাগাড়ে পড়ায় তাহলে বেতের চেয়ারও ফিফটি পার্সেন্ট নম্বর পেয়ে পাস করে যাবে। অঙ্কে পাবে সেভেন্টি পার্সেন্ট।
এই মাস্টারের তেমন কোনো বিশেষত্ব লিলির চোখে পড়ে নি। সে দেখেছে। মাস্টার সাহেব কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না। তিনি যতক্ষণ পড়ান ততক্ষণই মাথা নিচু করে থাকেন। এবং ততক্ষণই অতি কুৎসিত ভঙ্গিতে নাকের ভেতর থেকে লোম ছেঁড়ার চেষ্টা করেন। রুমু ঝুমু এই কুৎসিত দৃশ্য কিভাবে সহ্য করে লিলি জানে না। রুমু ঝুমুর জায়গায় সে হলে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে যেত। মাস্টার সাহেবকে খুন-টুন করে ফেলত।
রুমু ঝুমু দুজনই বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে। ঝুমু লিলির ছোট বোন, রুমু বড় চাচার একমাত্র মেয়ে। এরা দুজন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকে। কেউ কাউকে চোখের আড়াল করে না। তবে তারা যে গল্পগুজব করে তা না। কারও মুখে কোনো কথা নেই। নিঃশব্দ চলাফেরা। মাঝে মাঝে তারা কোনো একটা বিশেষ ধরনের অন্যায় করে, তখন ফরিদা দুজনকে ঘরে নিয়ে আটকান। দরজা-জানালা বন্ধ করে বেদম মারেন। মারতে মারতে নিজেই ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বের হয়ে আসেন। এরা টু শব্দ করে না। নিঃশব্দে মার খায়। লিলি যদি জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে মা?
তিনি ক্লান্ত গলায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, কিছু হয় নি।
ওদের মারলে কেন?
সারাক্ষণ মুখ ভোঁতা করে থাকে। মুখে কথা নেই, মারব না তো কি!
মায়ের কথা লিলির কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। সারাক্ষণ মুখ ভোতা করে রাখা, কারও সঙ্গে কথা না বলা এমন কোনো অপরাধ না যার জন্য দরজা-জানালা বন্ধ করে মারতে হয়। রুমু ঝুমুকে জিজ্ঞেস করলেও কিছু জানা যাবে না। এরা মরে গেলেও মুখ খুলবে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ফেলবে। ফিক ফিক করে হাসবে।
লিলি প্রায়ই ভাবে তাদের যদি আলাদা একটা বাড়ি থাকত। ছোট্ট একতলা একটা বাড়ি। দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনে অনেকখানি জায়গায় নানা ধরনের ফুল গাছ–আম-জাম-কাঁঠাল। একটা গাছে দোলনা ঝুলানো। বাড়িটা একতলা হলেও ছাদে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ছাদে অসংখ্য টবে ফুল গাছ। সেই বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই। শুধু তারাই থাকে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘর। তারা খেতে বসে একসঙ্গে এবং খাবার টেবিলে নানান গল্পগুজব করে। বাবা বলেন তাদের অফিসে মজার কি ঘটল সেই গল্প। লিলি বলে তার ইউনিভার্সিটির গল্প। ইউনিভার্সিটির কত অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা আছে। সেই ঘটনা শোনার মানুষ নেই। ঐ বাড়িটার পরিবেশ এমন হবে যে সবাই সবার গল্প শুনবে। কারও মজার কোনো কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হো হো করে হাসবে।
কোনো কোনো দিন ঝুম বৃষ্টির সময় একসঙ্গে সবাই ছাদে গিয়ে ভিজবে। বছরে একবার তারা বেড়াতে বের হবে। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কুয়াকাটা, সিলেটের চা বাগান। বাড়ির সুন্দর একটা নাম থাকবে–আয়না ঘর বা এই জাতীয় কিছু…
তাদের এখনকার এই বাড়িতে কোনো দিন এ-রকম কিছু হবে না। এই বাড়ির মা নির্বিকার ভঙ্গিতে তেলাপোকা চোবানো দুধ খাইয়ে দেবেন। বাবা হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে চেঁচামেচি করবেন খবরের কাগজের জন্য। রুমু ঝুমুর মাস্টার নাকের লোম ছিড়তে ছিড়তে পা দোলাবে। বড় চাচা সামান্য পায়ের শব্দেই কান খাড়া করে ডাকবেন–কে যায়? লিলি? জানালার একটা পাল্লা খুলে দিয়ে যা তো।