লিলি বলে না যে স্বাতী অসুস্থ। স্বাতী এখন তাকে পর্যন্ত চেনে না। লিলি তাকে গত কালও দেখতে গিয়েছিল। স্বাতী তাকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলেছে, বসুন। মা উনাকে বসতে দাও। রওশন আরা লিলির দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বললেন, কেন আমার মেয়েটা এ-রকম হলো? কেন হলো? লিলি এখন নিজের মতো তার বিয়ের প্রস্তুতি দেখে। তার ভালোও লাগে না, মন্দও লাগে না।
রাতে মা তার সঙ্গে ঘুমুতে আসেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকেন। লিলির তখনই শুধু খুব একা লাগে। তখন খুব অন্যায় একটা ইচ্ছার ছায়া মনে ভাসে। মনে হয়, ইশ কেউ একজন যদি স্বাতীর মতো একটা ছবি তার এঁকে দিত। কেউ একজন যদি তাকে দেখাতো কি করে আকাশের তারা নামিয়ে আনা যায়। সে খুব সন্তর্পণে কাঁদে। এমনভাবে কাঁদে যেন তার শরীর না কাঁপে। যেন তাঁর মা কিছু বুঝতে না পারেন। কিন্তু তিনি বুঝে ফেলেন। মেয়েকে প্রবলভাবে বুকে জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন, মা রে তোর যদি সত্যি সত্যি মনের মানুষ কেউ থাকে তুই পালিয়ে চলে যা তার কাছে। কী আর হবে? তোর বাবা আমাকে ধরে মারবে। এটা তো নতুন কিছু না।
লিলি অস্পষ্ট স্বরে বলে, মনের মানুষ কেউ নেই মা।
লিলির মা লিলির চেয়েও নিচু গলায় বলেন, সত্যি নেই? একদিন যে কোথায় গেলি। অনেক রাত করে ফিরলি…
লিলি হাসে। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসে। অনেকটা স্বাতীর মতো করেই হাসে। লিলির মা মেয়ের সেই হাসির মানে ধরতে পারেন না। তার বড় কষ্ট হয়।
লিলি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি এত ভালো কেন মা? তুমি, বাবা, ছোট চাচা, বড় চাচা, রুমু ঝুমু। তোমরা যদি আরেকটু কম ভালো হতে তাহলে আমার এত কষ্ট হতো না।
লিলি কাঁদে।
মা তার গায়ে-মাথায় ক্রমাগতই হাত বুলিয়ে দেন।
রুবিদের ফ্লাইট রাত আটটায়
রুবিদের ফ্লাইট রাত আটটায়। জাহিনের জিনিসপত্র গোছানো হয়েছে একদিন আগেই। যাবার দিনে তার কিছু গোছানোর নেই। সে ঠিক করে রেখেছিল যাবার দিনটা সারাক্ষণ সে বাবার সঙ্গে গল্প করবে। কিন্তু হাসনাত সকাল থেকেই স্টুডিওতে। দরজা বন্ধ করে কাজ করছে গত রাতের পুরোটাই কেটেছে স্টুডিওতে। গভীর রাতে জাহিনের ঘুম ভেঙেছে। সে দেখে বিছানা খালি। স্টুডিওতে আলো জ্বলছে। একবার সে ভাবল বাবাকে ডাকে। শেষ পর্যন্ত ডাকল না। স্টুডিওর দরজার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার পাশে কোলবালিশ। বালিশটাকে বাবা ভেবে সে জড়িয়ে ধরে থাকল।
স্টুডিও থেকে হাসনাত বের হলো দুপুরে। সে ভেবে রেখেছিল ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে মেয়েকে নিয়ে যাবে। তার হাতে তেমন সময় নেই। তার খুব ইচ্ছা প্লেনে ওঠার সময় মেয়ের হাতে একটা ছবি তুলে দেবে। বেশ কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে নষ্ট করার সময় নেই। হাসনাত বলল, টোস্ট আর ডিমভাজা খেয়ে ফেললে কেমন হয় মা?
জাহিন বলল, খুব ভালো হয়।
হাসনাত ডিম ভাজল। রুটি টোস্ট করার সময় নেই। এমি খেয়ে নিলেই হয়।
জাহিন!
জি বাবা।
আজ একটু খারাপ খেলে কিছু হবে না। প্লেনে কত ভালো ভালো খাবার দেবে। তাই না?
হুঁ।
আমি ছবিটা শেষ করতে থাকি, তুই কাপড়-টাপড় পরে তৈরি হতে থাক।
আচ্ছা।
জাহিন একা একা একা বারান্দায় হাঁটল। বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরল। এবং মাঝে মাঝেই স্টুডিওর দরজার পাশে এসে দাঁড়াতে লাগল। একবার মনে-মনে ডাকল, বাবা। মনের ডাক কেউ শুনতে পায় না। হাসনাত শুনল না। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় ছবিতে।
সন্ধ্যায় রুবি যখন গাড়ি নিয়ে এসে হর্ন বাজাচ্ছে তখন হাসনাতের ছবি শেষ হলো। সে কাগজে মুড়ে ছবিটা মেয়ের হাতে দিয়ে হাসল।
হাসি দেখেই জাহিন বুঝেছে, বাবা খুব সুন্দর ছবি এঁকেছে। তবে ছবিটা সে এখন দেখবে না। প্লেনে উঠে দেখবে।
হাসনাত বলল, মা, তুমি তোমার পড়ার ঘরে ছবিটা টানিয়ে রেখো।
জাহিন বলল, আচ্ছা।
হাসনাত বলল, তাহলে আর খুশি করে লাভ নেই, তোমরা রওনা হয়ে যাও।
রুবি বিস্মিত হয়ে বলল, রওনা হয়ে যাও মানে? তুমি সি অফ করতে যাবে না?
ইচ্ছে করছে না। খুব ক্লান্ত লাগছে।
ক্লান্ত লাগলেও চলো।
হাসনাত বিষণ্ণ গলায় বলল, বিদায়ের দৃশ্য আমার ভালো লাগে না।
কারোই ভালো লাগে না। তারপরেও তো লোকজন বিদায় দিতে যায়। যায় না?
এয়ারপোর্টে গাদাগাদি ভিড়। কী ভয়ানক ব্যস্ততা চারদিকে! কেউ যেন কাউকে চেনে না।
জাহিনের কাঁধে একটা হ্যান্ডব্যাগ, এক হাতে সে মাকে ধরে রেখেছে। অন্য হাতে কাগজে মোড়া ছবি। ছবিটা সে বুকের কাছে ব্যক্ত করে ধরে আছে।
হাসনাত এক কোনায় দাঁড়িয়ে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। জাহিন মার হাত ধরে গটগট করে এগুচ্ছে। নতুন কেনা গোলাপি ফ্রকে তাকে লাগছে পরীদের কোনো শিশুর মতো। সে একবারও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে না।
রুবি বলল, মা তুমি বাবার কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই চলে এসেছ। আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি, তুমি যাও বাবাকে চুমু দিয়ে আসো।
জাহিন শান্ত গলায় বলল, না।
না কেন মা?”
বাবাকে চুমু খেলে বাবা কাঁদতে শুরু করবে। বাবাকে কাঁদাতে ইচ্ছা করছে না।
কিন্তু তোমার বাবা হয়তো তোমাকে চুমু দেয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। তুমি না গেলে কষ্ট পাবেন।
বাবা জানে আমি কেন যাচ্ছি না। বাবার অনেক বুদ্ধি।