লিলি চুপ করে রইল।
.
স্বাতী তীব্র গলায় বলল, তোর সাহসের এত অভাব কেনরে লিলি। একটু সাহসী হ। আমার সঙ্গে এতদিন থেকেও তোর সাহস হলো না এটাই আশ্চর্য। আমি কী প্রচণ্ড সাহসী একটা কাজ করতে যাচ্ছি তা কি জানিস?
না।
মাকে জিজ্ঞেস করিস। মা বলবে। নাও বলতে পারে। মাও তো তোর মতোই একটা মেয়ে। শাড়ি দিয়ে শরীর ঢাকতে ঢাকতে সবকিছু ঢাকার অভ্যাস হয়ে গেছে।
স্বাতী, আমি যাই।
যা। ওকে জিজ্ঞেস করিস তো কোন সাহসে আমার চিবুকে সে লাল তিল আঁকল?
লিলি সিঁড়ি দিয়ে নামছে। একতলায় স্বাতীর মার সঙ্গে তার দেখা হলো। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, মেয়েটার মাথা খারপ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। ও প্রায়ই আমাকে চিনতে পারে না।
এইসব কী বলছেন খালা!
সত্যি কথা বলছি মা। সত্যি কথা বলছি। ও আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজে শাস্তি পাচ্ছে।
তিনি ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
.
হাসনাত বাসায় ছিল। লিলিকে দেখে সে খুব অবাক হলো। লিলি বলল, জাহিন কোথায়?
ও তার মার হোটেলে। ওর মা এসেছে ওকে নিয়ে যেতে।
আমি জানি। জাহিন আমাকে সব বলেছে।
ওর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে জানি না তো। জাহিন আমাকে কিছুই বলে নি। ভেতরে এসো লিলি।
আমি আপনাকে একটা কার্ড দিতে এসেছি।
বিয়ের কার্ড।
হ্যাঁ। বুঝলেন কী করে বিয়ের কার্ড?
অনুমান করেছি।
আপনি বিয়েতে এলে আমি খুব খুশি হব।
আমি যাব, আমি অবশ্যই যাব।
আরেকটা কাজ যদি করেন তাহলেও আমি খুব খুশি হব।
বলো, আমি অবশ্যই করব।
স্বাতীর সঙ্গে যদি একটু দেখা করেন। ও ভয়াবহ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
লিলি, আমি সেটা জানি। আমি গিয়েছিলাম ওর কাছে। স্বাতী আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয় নি।
লিলি এসো, ভেতরে এসে বসো।
জি না, আমি বসব না।
হাসনাত ক্লান্ত গলায় বলল, স্বাতীর ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। রুবির ব্যাপারটাও বুঝি নি। কাউকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। এইটুকু শুধু জানি। বাস্তবে কাউকে ধরে রাখতে পারি না বলেই বোধহয় ছবিতে ধরে রাখতে পারি।
লিলি বলল, আমি যাই?
হাসনাত বলল, তুমি কি ঘণ্টাখানেক বসতে পারবে? ঘণ্টাখানেক বসলে অতি দ্রুত একটা ছবি এঁকে ফেলতাম। মাঝে মাঝে আমি খুব দ্রুত কাজ করতে পারি।
জি না। আমি এখন যাব।
হাসনাত গেট পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে এল। হঠাৎ তাকে অবাক করে দিয়ে লিলি নিচু হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল।
হাসনাত বলল, আমি প্রার্থনা করছি তোমার জীবন মঙ্গলময় হবে।
বিংশ শতাব্দীর সপ্তম আশ্চর্যজনক ঘটনা
বিংশ শতাব্দীর সপ্তম আশ্চর্যজনক ঘটনাটা ঘটে গেছে।
জাহেদুর রহমান আমেরিকান ভিসা পেয়েছে। সে অসম্ভব অবাক হয়ে লক্ষ করল তার কোনো রকম আনন্দ হচ্ছে না। বরং হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেছে। মনে হয় আর কিছুই করার নেই। সে গুলশান থেকে বাসায় ফিরল হেঁটে হেঁটে এবং প্রথম বারের মতো এই নোংরা দেশের সবকিছুই তার অসম্ভব ভালো লাগতে লাগল। ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে রিকশা যাচ্ছে–কী সুন্দর লাগছে দেখতে! রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফুটেছে—-আহা কী দৃশ্য! আকাশজোড়া ঘন কালো মেঘ। বর্ষা আসি আসি করছে। আসল কালো মেঘগুলো বের হবে বর্ষায়। দিনরাত বর্ষণ হবে। রাস্তায় পানি জমে যাবে। সেই পানি ভেঙে বাসায় ফেরা। এই আনন্দের তুলনা কোথায়?
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো–সমস্যার আনন্দ। চারদিকে সমস্যা কি কম? লিলির বিয়ে হচ্ছে। কত রকম ঝামেলা, রুমু ঝুমু বড় হচ্ছে, এদের বিয়ে দিতে হবে। সমস্যার কি কোনো শেষ আছে? বাড়িটা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। সেই ঝামেলাও মেটাতে হবে। সব ছেড়ে বিদেশে গিয়ে পড়ে থাকলে হবে? কী আছে শাদা চামড়ার দেশে? সমস্যাহীন ঐ দেশে থেকে হবেটা কী?
বাড়ি ফেরার পথে জাহেদুর রহমান বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গেল। যাকে বলে ঝুম বৃষ্টি। এত ভালো লাগছে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে। পাসপোর্টটা ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছে। ভিজুক। হু কেয়ারস? শালার পাসপোর্ট।
কাকভেজা হয়ে জাহেদুর রহমান বাড়িতে ঢুকল। প্রথমেই দেখা হলো লিলির সঙ্গে। লিলি শঙ্কিত গলায় বলল, ভিসা এবারও হয় নি, তাই না?
জাহেদুর রহমান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, না।
লিলি বিষণ্ণ গলায় বলল, তুমি মন খারাপ করো না ছোট চাচা। তোমার মনটা এত খারাপ দেখে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে।–আহারে, মেয়েটা তো সত্যি কাঁদছে।
জাহেদুর রহমানের চোখ ভিজে উঠছে–বিদেশ বিভূঁইয়ে কে তার জন্য চোখের জল ফেলবে। কেউ না।
ছোট চাচা!
কী রে!
মন খারাপ করো না ছোট চাচা, প্লিজ।
আচ্ছা যা মন খারাপ করব না।
পরের বার নিশ্চয়ই হবে।
আর এ্যাপ্লাই করব না। যথেষ্ট হয়েছে, এখন কষ্টটষ্ট করে দেশেই থাকব।
জাহেদুর রহমান তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার দিকে যাচ্ছে। এত ভালো লাগছে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে।
.
বিয়ে উপলক্ষে অনেকদিন পর লিলিদের বাড়ি চুনকাম হচ্ছে। পুরনো বাড়ি সাজতে শুরু করেছে নতুন সাজে। বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলোও কি বদলাচ্ছে? নেয়ামত সাহেব মেয়ের সঙ্গে যে অস্বাভাবিক নরম গলায় কথা বলেন সেই কথায় লিলির চোখে প্রায়ই পানি এসে যায়। সেদিন হঠাৎ বললেন, মাগো কাছে বস তো একটু।
লিলি কাছে বসল। নেয়ামত সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ পর কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, তোর ঐ বান্ধবী কি যেন নাম স্বাতী। আসে না কেন? বিয়ের সময় বন্ধুবান্ধব আশপাশে থাকলে মনটা ভালো থাকে। ওকে খবর দিয়ে নিয়ে আয়, থাকুক কয়েক দিন তোর সাথে।