কেউ তো আসছে না।
তাই তো দেখছি। চলো ঢুকে পড়ি।
তারা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রুবি অবাক হয়ে দেখল অবিকল পরীর মতো মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে তাদের দেখে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমে আসছে। এসেই মেয়েটি জাহিনকে কোলে তুলে নিল। জাহিন মেয়েটির শাড়িতে মুখ চেপে রেখেছে। তার ছোট্ট শরীর কাঁপছে। সে কাঁদছে। রুবির বিস্ময়ের সীমা রইল না।
প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাবার পর লিলি লজ্জিত ভঙ্গিতে রুবির দিকে তাকাল। রুবি বলল, যে মেয়েটি আপনার কোলে বসে কাঁদছে আমি তার মা। হুট কর ঢুকে পড়েছি।
খুব ভালো করেছেন।
লিলি কিশোরীদের মতো গলায় পেঁচিয়ে বলল, মা দেখো! দেখো কে এসেছে। ফরিদা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বললেন, কে এসেছে?
জাহিন এসেছে। জাহিন।
জাহিনটা কে?
লিলি জবাব দিতে পারছে না। সে লজ্জিত ও বিব্রত মুখে মার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহিন মেয়েটা তাকে খুব লজ্জায়ও ফেলে দিয়েছে। কেঁদে কেঁদে তার শাড়ি প্রায় ভিজিয়ে ফেলেছে। এত কাঁদছে কেন মেয়েটা?
বাড়ির সবাই এসে ভিড় করছে। রুমু ঝুমু এসেছে, বড় চাচা সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, ছোট চাচাকেও দেখা যাচ্ছে। কাজের দুই বুয়াও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। রুবি বলল, আমার মেয়েটা কিছুক্ষণ থাকুক আপনার কাছে। আমি পরে এসে নিয়ে যাব।
লিলি হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারল না। জাহিনের কান্নার কারণে তার নিজেরও এখন কান্না এসে গেছে।
জাহিনের মা চলে যাচ্ছেন, সে তাঁকে এগিয়ে দিতে পর্যন্ত গেল না। অভদ্রের মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। ফরিদা বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কি! এই মেয়ে কে?
একজন আর্টিস্টের মেয়ে মা, হাসনাত সাহেবের মেয়ে?
তুই কাঁদছিস কেনরে লিলি। মেয়েটা কাঁদছে, তুইও কাঁদছিস। ব্যাপারটা কি?
ফরিদার বিস্ময় কিছুতেই কমছে না।
সকাল বেলাতেই নেয়ামত সাহেবের ঘরে
সকাল বেলাতেই নেয়ামত সাহেবের ঘরে লিলির ডাক পড়েছে। লিলি ভয়ে ভয়ে উপস্থিত হলো! নেয়ামত সাহেব অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, মা বসো।
লিলি বসল।
মা, কাছে এসে বসো।
লিলি বাবার কাছে একটু সরে এলো। খুব কাছে আসতে লজ্জা লাগছে। বাবা তুমি তুমি করে বলছেন। তাতেও লজ্জা লাগছে।
তোমার বিয়ের কার্ড ছাপা হয়েছে দেখো। হাতে নিয়ে দেখো। লজ্জার কিছু নেই। হারামজাদারা একটা বানান ভুল করেছে। শুভ লিখেছে দন্ত্যে স দিয়ে, ধরে চাবকানো দরকার। তবে ছেপেছে ভালো। কার্ড পছন্দ হয়েছে মা?”
জি বাবা।
শুভ বানানটার জন্য মনের ভিতর একটা খচখচানি রয়ে গেল। যাই হোক কি আর করা! তোমার কয়টা কার্ড দরকার বল তো মা।
আমার কার্ড লাগবে না বাবা।
কার্ড লাগবে না মানে। অবশ্যই লাগবে। বন্ধু-বান্ধবদের নিজের হাতে দাওয়াত দিয়ে আসবে। এইসব ব্যাপারে আমি খুব আধুনিক। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি সারাদিনের জন্য গাড়ি তোমার। বিশটা কার্ডে হবে মা?
জি হবে।
ফ্যামিলিসুদ্ধ দাওয়াত দেবে। দাওয়াতে কার্পণ্য করবে না। নাও মা, কার্ডগুলো নাও–হারামজাদারা শুভ বানানে গণ্ডগোল করে মনটা খারাপ করে দিয়েছে। যাই হোক, কি আর করা। মা, দাওয়াত দেয়ার সময় মুখে বলবে, উপহার আনতে হবে না। দোয়াই কাম্য। কার্ডে লিখে দেয়া উচিত ছিল। অনেকেই আবার এসব লিখলে মাইন্ড করে বলে লেখা হয় নাই।
বাবা, আমি যাই?
আচ্ছা মা, যাও। যেসব বাড়িতে যাবে সেখানে মুরুব্বি কেউ থাকলে পা ছুঁয়ে সালাম করবে। মুরুব্বিদের দোয়া যে কত কাজে লাগে তা তোমরা জানো না। জগৎ সংসার টিকেই থাকে মুরুব্বিদের দোয়ায়।
স্বাতী গভীর আগ্রহে বিয়ের কার্ড দেখছে। লিলি তাকিয়ে আছে স্বাতীর দিকে। কী চেহারা হয়েছে স্বাতীর! যেন সে কতদিন ধরে ঘুমুচ্ছে না, খাচ্ছে না।
তুই এমন হয়ে গেছিস কেন স্বাতী?
কেমন হয়ে গেছি? পেত্নী?
প্রায় সে-রকমই।
রাতে ঘুম হয় না, বুঝলি লিলি, এক ফোঁটা ঘুম হয় না। গাদাগাদা ঘুমের ওষুধ খাই। তারপরেও ঘুম হয় না। মার ধারণা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
তোর নিজের কী ধারণা?
আমারও সে রকমই ধারণা। কাল রাত তিনটার সময় হঠাৎ হো হো করে এমন হাসি শুরু করলাম–আমি হাসি মা কাঁদে। মা যত কাঁদে, আমি ততই হাসি।
তোর সমস্যা কী?
আমার অনেক সমস্যা। তোকে সব বলতে পারব না।
আমি তোকে একটা পরামর্শ দেব?
দে।
তুই হাসনাত সাহেবের কাছে ফিরে যা।
স্বাতী রাগী গলায় বলল, কেন ফিরে যাব? ভালোবাসার জন্য ফিরে যাব? ওকে ভালোবাসি তোকে কে বলল? ভালোবাসা কখনও এক তরফা হয় না। ও কি। ভালোবাসে আমাকে? কখনও না। আমার একটা ছবি এঁকেছে। ছবিটা তুই ভালো করে লক্ষ করেছিস? ভালো করে দেখ। ছবির মেয়েটার চিবুকে লাল তিল আছে। আমার চিবুকে লাল তিল আছে? কোত্থেকে এই তিল এল? তার স্ত্রীর চিবুকে তিল ছিল। ওর কোনো প্রেমিকা দরকার নেই। ওর দরকার জাহিনের দেখাশোনার জন্য একজন মা। ওকে বিয়ে করলে আমাকে কী করতে হবে জানিস? ওর স্ত্রীর ভূমিকায়
অভিনয় করতে হবে। আমি কোনোদিনও তা করব না।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুই শান্ত হ।
স্বাতী চুপ করল। বড় বড় করে নিশ্বাস নিতে লাগল। লিলি বলল, আমি এখন যাই স্বাতী?
কোথায় যাবি? হাসনাতের ওখানে?
লিলি কিছু বলল না, চুপ করে রইল। স্বাতী বলল, আমি তোর চোখ দেখেই বুঝেছি তুই তার কাছে যাবি। বিয়ের দাওয়াতের অজুহাতে যাবি। তাই না?