তারা দুজনই দৌড়াচ্ছে। স্বাতীর গাভর্তি ঝলমলে গয়না। গয়না থেকে ঝমঝম শব্দ আসছে। লিলি ভাবছে, বিয়ে হচ্ছে তার আর স্বাতীর গায়ে এত গয়না কেন?
রাতের ভয়ঙ্কর স্বপ্ন সাধারণত দিনে হাস্যকর লাগে। এই স্বপ্নটা লাগছে না। ভোরবেলা দাঁত মাজতে মাজতে লিলির মনে হলো–স্বপ্নটার কোনো খারাপ অর্থ নেই তো? মার কাছে খোয়াবনামার একটা বই আছে। বই থেকে স্বপ্নের কোনো অর্থ পাওয়া যাবে?
লিলি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দাঁত মাজল। আয়নায় নিজেকে দেখতে-দেখতে পতি ব্রাশ করার আলাদা আনন্দ। তবে আজ আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগছে না। ঘুম না হওয়ায় চোখ লাল হয়ে আছে। চেহারাটাও কেমন শুকনা শুকনা লাগছে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে লিলি ইতস্তত করতে লাগল। সে কি একতলায় যাবে? শতা দেয়া হয়েছে কি-না দেখবে? না নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বই নিয়ে শশবে? আজ বই নিয়ে বসেও লাভ হবে না। মাথায় পড়া ঢুকবে না। তারচেয়ে নিচে যাওয়াই ভালো। নিচে যাওয়ামাত্র এই বাড়ির প্রবল স্রোতের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। মিশতে ইচ্ছা করে না। পৃথিবীতে বাস করতে হলে ইচ্ছে না থাকলেও অনেক কিছু করতে হয়।
লিলি তার বড় চাচার ঘরের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল।
বড় চাচা আজহার উদ্দিন খাঁ সাহেবের দরজা ভেজানো। ভেতর থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। অর্থাৎ, তিনি জেগে আছেন। তিনি জেগে থাকলে বিরাট সমস্যা, তাঁর বন্ধ দরজার সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি প্রায় অলৌকিক উপায়ে টের পেয়ে যাবেন এবং শ্লেষ্ম জড়ানো ভারী গলায় ডাকবেন, কে যায়? লিলি না? মা, একটু শুনে যা তো!
এই ডাকার পেছনে কোনো কারণ নেই। অকারণে ডাকা।
পর্দাটা টেনে দে তো।
কটা বাজছে দেখ তো।
তার ঘরের দেয়ালেই ঘড়ি, তিনি মাথা হেলিয়ে ঘড়ি দেখতে পারেন। হাত বাড়ালেই পর্দা। পর্দা টানার জন্য বাইরের কাউকে ডাকতে হয় না। এমন না যে, তার ঘাড়ে ব্যথা মাথা ঘুরাতে পারেন না, কিংবা হাতে প্যারালাইসিস হয়েছে, হাত বাড়িয়ে পর্দা ছুঁতে পারেন না।
আজও লিলি বড় চাচার ঘরের সামনে দিয়ে পা টিপে টিপে যাচ্ছিল বড় চাচা ডাকলেন, শুনে যা।
লিলি মুখ কালো করে ঘরে ঢুকল।
একতলায় হইচই হচ্ছে কেন?
লিলি কী করে বলবে কেন? বড় চাচা যেমন দোতলায়, লিলিও তেমনি দোতলায়।
ভোরবেলাতেই হইচই চেঁচামেচি। দেখে আয় তো ব্যাপারটা কী?
লিলি ব্যাপার দেখার জন্য নিচে নেমে এসে হাঁপ ছাড়ল। বড় চাচার বেলায় একটা সুবিধা হচ্ছে তাঁর স্মৃতিশক্তি নেই বললেই হয়। একতলার হইচইয়ের কারণ লিলিকে আবার ফিরে গিয়ে জানাতে হবে না। তিনি এর মধ্যে ভুলে যাবেন। এমন ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির একটা মানুষ এত বড় সরকারি চাকরি দীর্ঘদিন কী করে করলেন সে এক রহস্য। কে জানে সরকারি চাকরিতে হয়তো-বা স্মৃতিশক্তির কোনো ভূমিকা নেই। এই জিনিস যার যত কম থাকবে সে তত নাম করবে।
একতলায় হইচইয়ের কারণ জানার লিলির কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু হইচইটা এমন পর্যায়ের যে আগ্রহ না থাকলেও জানতে হলো। তাদের দুধওয়ালার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। গতকাল সে তিন লিটার দুধ দিয়েছিল। সেই দুধ জ্বাল দেবার পর সেখানে একটা মরা তেলাপোকা পাওয়া গেছে। লিলিদের বুয়া সেই তেলাপোকা প্রমাণস্বরূপ খানিকটা দুধসহ একটা গ্লাসে রেখে দিয়েছে। প্রমাণসহ মামলা। দুধওয়ালা প্রমাণ গ্রাহ্য করছে না। অতি মিষ্টি ভাষায় সে বলছে–তেইল্যাচুরা জম্মেও দুধ খায় না।
লিলির ছোট চাচা জাহেদুর রহমান ফরিয়াদি পক্ষের উকিলের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, তেলাপোকা দুধ খায় না?
জে না স্যার?
সে কী খায়?
তেল খায়। এইজন্য এর নাম তেইল্যাচুরা।
দুধ খাক বা না খাক তোমার আনা দুধের মধ্যে তাকে পাওয়া গেছে। …
লিলির গা ঘিনঘিন করছে। তেলাপোকা তার কাছে জগতের কুৎসিত প্রাণীদের একটি। তার মন বলছে গতকাল বিকেলে এই তেলাপোকা ভেজানো দুধই তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। পুরো এক গ্লাস। তাদের বাড়ি এমন না যে সামান্য তেলাপোকার কারণে পুরো তিন লিটার দুধ ফেলে দেয়া হবে। লিলি রান্নাঘরে তার মাকে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মা কাল বিকেলে তুমি যে আমাকে দুধ খেতে দিলে সেটা কি তেলাপোকা মাখা দুধ?
ফরিদা পেঁপের হালুয়া বানাচ্ছেন। তিনি চোখ না তুলেই বললেন, আরে না। কী যে তুই বলিস!
কাল যে দুধ খেলাম সেটা কোন দুধ?”
তার আগের দিনের দুধ। ফ্রিজে তোলা ছিল। তোকে গরম করে দিয়েছি।
তেলাপোকার দুধ কী করেছ?
ফরিদা বিরক্ত মুখে বললেন, তোকে খেতে দেইনি বললাম তো। কেন অকারণে ঘ্যানঘ্যান করছিস?”
লিলির বমি বমি লাগছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। কী অবলীলায় মা মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। মিথ্যা বলার সময় তাঁর মুখের চামড়া পর্যন্ত কুঁচকাচ্ছে না!
ফরিদা বললেন, লিলি যা তো, তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে আয় চা খাবে না কি। কাল রাতে বেচারা যা কষ্ট করেছে। পেটে গ্যাস হয়েছে। গ্যাস বুকে চাপ দিচ্ছে। এই বয়সে গ্যাস ভালো কথা না। গ্যাস থেকে হার্টের ট্রাবল হয়।
লিলি বলল, তেলাপোকার দুধ কী করেছ?
ফরিদা চোখ তুলে তাকালেন। তাঁর চোখে বিরক্তি নেই, আনন্দও নেই। পাথরের মতো চোখ-মুখ। দীর্ঘদিন সংসারে থাকলে মায়েরা রোবট জাতীয় হয়ে যান। কোনো কিছুই তাদের স্পর্শ করে না। ফরিদা নিশ্বাস ফেলে বললেন, যন্ত্রণা করিস না তো লিলি।