তোমার যেমন নিশিরাতে চাবি খুলে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে দেখার অভ্যাস, আমার তেমনি মাঝে মাঝে তোমাদের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তোমাদের কথা শোনার অভ্যাস হয়ে গেল।
আমি যে অন্যায়টা করেছি খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও সেই অন্যায়ের পেছনে তোমার একটা ভূমিকা আছে, সত্যি আছে। তুমি তোমার প্রথম যৌবনে যে অন্যায়টা করেছিলে–আমি সব সময় ভেবেছি সেই অন্যায় আমিও করব। এ-রকম অদ্ভুত ইচ্ছার কারণ তোমার প্রতি ভালবাসাও হতে পারে, আবার তোমার প্রতি ঘৃণাও হতে পারে। ঠিক কোনটা আমি জানি না।
মা, তোমাকে সত্যি কথা বলি। ঐ ভদ্রলোকের জন্য আমার ভেতর সাময়িক প্রবল মোহ অবশ্যই তৈরি হয়েছিল। তা না হলে এত বড় অন্যায় করা যায় না। তবে সত্যিকার ভালোবাসা বলতে যা তা বোধহয় আমার তাঁর প্রতি হয় নি। কাজেই তাকে বিয়ে না করলেও কিছু যায় আসে না। বিয়ে না করাটাই বরং ভালো। আমার বর্তমান যে শারীরিক সমস্যা তা আমি তোমার মতো করে মিটাতে পারি। ভালো একটা ক্লিনিকে ভর্তি হতে পারি। পনেরো-কুড়ি মিনটের ব্যাপার। কেউ কিছু বুঝতেও পারবে না। আমি কিন্তু তা করব না মা।
রওশন আরা ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, তুই কী করবি?
স্বাতী শান্ত গলায় বলল, যে শিশুটি পৃথিবীতে আসতে চাচ্ছে আমি তাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসব। তাকে বড় করব। তাকে শুদ্ধতম মানুষ হিসেবে বড় করব।
তার কোনো বাবা থাকবে না?
স্বাতী সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আমার কথা শেষ হয়েছে। বাতি জ্বালাব?
না।
এখনও কি তোমার আমার বিছানায় বসে থাকতে ঘেন্না লাগছে?
রওশন আরা জবাব দিলেন না। স্বাতী বলল, কফি খাবে মা? কফি বানিয়ে আনব?
রওশন আরা সেই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না স্বাতী হাসছে। শুরুতে অস্পষ্টভাবে হাসলেও শেষে বেশ শব্দ করেই হাসতে শুরু করল। সেই হাসির শব্দ পুরোপুরি স্বাভাবিক মানুষের শব্দের মতো না। কোথাও যেন এক ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে। রওশন আরা চমকে চমকে উঠছেন। স্বাতী হঠাৎ হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, মা যাও, ঘুমুতে যাও।
রওশন আরা উঠলেন। প্রায় নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হলেন। নিজের শোবার ঘরে ঢুকলেন। নাজমুল সাহেব বললেন, তুমি কী ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছ কে জানে? এক ফোঁটা ঘুম আসছে না। জেগেই আছি। রওশন আরা জবাব দিলেন না। দরজায় কাছেই দাঁড়িয়ে রইলেন। নাজমুল সাহেব বললেন, এতক্ষণ কী গল্প করছিলে? আশ্চর্য! এসো, ঘুমুতে এসো।
রওশন আরা শোবার ঘরের দরজা লাগিয়ে বিছানায় এলেন আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্বাতী এসে দরজায় টোকা দিল। করুণ গলায় ডাকল, বাবা!
নাজমুল সাহেব চমকে উঠে বসলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, কী হয়েছে মা?
স্বাতী কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমার কেন জানি ভয় ভয় লাগছে। বাবা, আমি কি শুধু আজ রাতের জন্য তোমাদের দুজনের মাঝখানে ঘুমুতে পারি? শুধু আজ রাতের জন্য?
জাহিন খুব অবাক হয়ে দেখছে
জাহিন খুব অবাক হয়ে দেখছে। এত সুন্দর কোনো মেয়ে সে বোধহয় এর আগে দেখে নি। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, মাথাভর্তি চুল ঢেউয়ের মতো নেমে এসেছে। এমন চুল যে হাত দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে মন খারাপ লাগে। মেয়েটা মুখ টিপে কি সুন্দর ভঙ্গিতেই না হাসছে।
তোমার নাম জাহিন, তাই তো?
হ্যাঁ।
তোমার জ্বর হয়েছিল, সেরেছে?
হ্যাঁ!
আমি কে তা কি তুমি জানো?
জাহিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সে জানে। অবশ্যই জানে। এই পরীর মতো মেয়েটা তার মা।
তুমি এত রোগা কেন?
জানি না।
তোমার মাথায় চুল এত কম কেন? দেখো তো আমার মাথায় কত চুল। হাত ছুঁয়ে দেখো। আমি ভেবেছিলাম তোমারও মাথাভর্তি চুল থাকবে তোমার বাবা কি বাসায় আছে?
আছে।
ছবি আঁকছে?
না। ছবি আঁকার ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
চুপচাপ যে বসে আছে সেটা বুঝলে কি করে?
পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি মাঝে মাঝে দেখি।
পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখার দরকার কী? স্টুডিওতে সরাসরি ঢুকে যাও না কেন? বাবা রাগ করে?
রাগ করে না। কঠিন চোখে তাকায়!
আমি তোমার দিকে কোন চোখে তাকাচ্ছি বলো তো?
জাহিন হাসল। লজ্জার হাসি। তার হঠাৎ অসম্ভব লজ্জা লাগছে। আবার অসম্ভব ভালো লাগছে। সে হাত বাড়িয়ে মার চুল স্পর্শ করল।
জাহিন, বলো তো আমি কে?
মা।
কার মা?
জাহিন আবার লজ্জা পেয়ে হাসল। কিন্তু কার মা তা বলল না।
তুমি কি আমার নাম জানো?”
জানি।
বলো, আমার নাম কী বলো?
আপনার নাম রুবি।
আমার সম্পর্কে আর কী জানো?
আপনি খুব সুন্দর নাচতে পারেন।
তুমি কি আমার কোলে আসবে?
জাহিন না সূচক মাথা নাড়ল। যদিও তার খুব ইচ্ছা করছে কোলে উঠতে। রুবি বলল, আমার কোলে আসবে না কেন, আমি কি খারাপ মেয়ে?”
জাহিন ক্ষীণস্বরে বলল, অল্প খারাপ।
কেন? তোমার বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম সেই জন্য?
হুঁ।
আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে?
কোথায়?
তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানেই যাব। চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডন, বুড়িগঙ্গা নদী।
আপনি কি স্বাতী আন্টিদের বাসা চেনেন?
না, চিনি না। ঠিকানা বের করে সেখানে অবশ্যই যেতে পারি। স্বাতী আন্টিটি কে?
বাবার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হয়েছিল। তারপর হয় নি।
হয় নি কেন?
আমি জানি না।
তবু তোমার অনুমানটা কী?
স্বাতী আন্টির বাবাকে পছন্দ হয় নি। বাবাকে কেউ পছন্দ করে না।
আর কে পছন্দ করে নি?
আপনি করেন নি।
ও হ্যাঁ, তাও তো ঠিক। তুমি তাকে খুব পছন্দ করো?