স্বাতী প্রায় অস্পষ্টস্বরে বলল, হ্যাঁ।
রওশন আরা বললেন, তোর লুকিয়ে রাখা ছবিটা আমি দেখে ফেলেছি এইজন্য কি তুই রাগ করেছিস?
না। তুমি তালা খুলে আমার ঘরে ঢুকে আমার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করো সেটা আমি জানি। ছবিটাও দেখবে তাও জানতাম। তোমার দেখার জন্যই ছবিটা ঘরে খেছি। আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। তুমি ছবিটা দেখে আমার কাছে জানতে ইবে তখন পুরো ব্যাপারটা বলা আমার জন্য সহজ হবে। তুমি ছবি দেখেছ অথচ মামাকে কিছুই বল নি।
জাহিন ঐ ভদ্রলোকের মেয়ে?
হ্যাঁ, খুব চমৎকার একটা মেয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ঐ ভদ্রলোকের প্রেমে পড়িনি। মেয়েটার প্রেমে পড়েছি। এতক্ষণ যে মা-মেয়ের সংসারের গল্প করলাম এই ভেবেই বোধহয় করেছি।
ভদ্রলোকের স্ত্রী আছেন?
না।
তুই কি তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছিস?
হুঁ।
খুব ঘনিষ্ঠভাবে?
হুঁ।
রওশন আরা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। তাঁর চোখ ভিজে উঠেছে। এখনি হয়তো চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়বে। ঘর অন্ধকার, মেয়ে দেখতে পাবে না। এই টুকুই যা সান্ত্বনা।
মা তুমি কি আমাকে ঘেন্না করছ? আমার সঙ্গে এক বিছানায় বসে থাকতে তোমার কি ঘেন্না লাগছে?
তুই কি ঘেন্নার মতো কোনো কাজ করেছিস?
হা। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব ঘেন্নার কাজ করে ফেলেছি। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় না। মা, তুমি কি লক্ষ করেছ আমার শরীর খারাপ করেছে? কিছু খেতে পারছি না, ঠিকমতো ঘুমুতে পারছি না।
লক্ষ করেছি।
ঘর অন্ধকার করে আমি তোমার সঙ্গে খুব সহজভাবে কথা বলছি। তুমি কিছু মনে করো না। সহজভাবে কথা বলা ছাড়া আমার উপায় নেই। তুমি রাগ যা করার পরে করো। এখন আমার কথা শোনো।
শুনছি।
মা দেখো, ছেলে এবং মেয়ের ভালোবাসাবাসি প্রকৃতি খুব সহজ করে নি। কাটা বিছিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসতে গেলেই কাঁটা ফুটবে। অথচ দেখো, মেয়ে এবং মেয়ের ভেতর কি চমৎকার বন্ধুত্ব হতে পারে। দুজন ছেলের ভেতর বন্ধুত্ব হতে পারে। দুজন ছেলের ভেতর বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু যেই একটি ছেলে একটা মেয়ের কাছে যায় তাকে কাঁটা বিছানো পথে এগোতে হয়। কাঁটার কথা একসময় মনে থাকে না–পায়ে তখন কাঁটা ফোটে।
রওশন আরা ক্লান্ত গলায় বললেন, এত কাব্য করে কিছু বলার দরকার নেই, যা বলার সহজ করে বল। নোংরা কোনো ব্যাপার যত সুন্দর ভাষা দিয়েই বলা হোক সেটা নোংরাই থাকে। সুন্দর হয়ে যায় না।
মা প্লিজ, তুমি আমার কথাগুলো আমার মতো করে বলতে দাও। প্লিজ! প্লিজ!
বল, কী বলতে চাস?
কাটার কথাটা বলছিলাম মা। কাটা যখন ফোটে তখন কাঁটাটাকে ফুল বানানোর জন্য আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি। তড়িঘড়ি করে একটা বিয়ের ব্যবস্থা হয়। সবাই তখন ভান করতে থাকে কাঁটা ফুল হয়ে গেছে।
তুই ঠিক করেছিস বিয়ে করবি?
তাই ঠিক করা হলো মা। কাটার ভয়ে ঠিক করা হলো। তোমাদের না জানিয়ে বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা করা হয়ে গেল। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছো।
তুই তোর কথা বলে যা। আমি অবাক হচ্ছি না, সেটা পরের ব্যাপার।
বিয়ের ঠিক আগের রাতে আমার ঘুম হচ্ছিল না, আমি ছটফট করছিলাম, তখন হঠাৎ মনে হলো, এই বিয়েটা তো কোনো আনন্দের বিয়ে না। সমস্যার বিয়ে। সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিয়ে। একদিন আমাদের সংসারে একটা শিশু আসবে। যতবার তার দিকে তাকাব ততবার মনে হবে সে সংসারে ঢুকেছিল কাঁটা হিসেবে। স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হবে। হবে তো বটেই। তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা, বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, তোমরাই দুজন দুজনকে সহ্য করতে পারো না। আমরা কি করে সহ্য করব। মা, কি হবে জানো? কুৎসিত সব ঝগড়া হবে, দুজন দুজনের দিকে ঘৃণা নিয়ে তাকাক–সেই ঘৃণার সবটাই গিয়ে পড়বে আমার সন্তানের ওপর। মনে হবে তার কারণেই আমরা ঘৃণার ভেতর বড় হচ্ছি। মা ঠিক করে বলো তো, আমার সঙ্গে এক খাটে বসে থাকতে তোমার কি ঘেন্না লাগছে?
লাগছে।
লাগলেও আর একটুক্ষণ বসো। আমার কথা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কথা শেষ হলেই আমি তোমার জন্য কফি বানিয়ে আনব।
স্বাতী, কথা অনেক শুনে ফেলেছি। আমার আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। শেষটা খুব ইন্টারেস্টিং মা। শেষটা তোমাকে শুনতেই হবে–
আমি অনেক বয়স পর্যন্ত তোমাদের সঙ্গে ঘুমাতাম। আমি হলাম খুব আদরের মেয়ে, নক্ষত্রের নামে নাম। বাবা মার সঙ্গে তো ঘুমুবেই। আমি মাঝখানে, তোমরা দুজন দুদিকে। একটা হাত রাখতে হতো তোমার ওপর একটা হাত রাখতে হতো বাবার ওপর। তোমার দিকে তাকিয়ে ঘুমুলে বাবা রাগ করত, বাবার দিকে তাকিয়ে ঘুমুলে তুমি রাগ করতে। নকল রাগের মজার খেলার ভেতর দিয়ে আমি বড় হচ্ছি–চার বছর থেকে পাঁচ বছরে পড়লাম, তারপর প্রচণ্ড রকম ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আলাদা থাকার জন্য, আলাদা ঘরের জন্য। আমার প্রচণ্ড ভূতের ভয়, তারপরেও আলাদা থাকার জন্য কি কান্না তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। মনে আছে মামা?”
হ্যাঁ, মনে আছে?
ভূতের ভয়ে কাতর ভীতু একটা মেয়ে আলাদা থাকার জন্য কেন এত ব্যস্ত সেটা নিয়ে তোমরা কখনও মাথা ঘামাও নি। কারণ, কখনও জানতে চাও নি। ধরেই নিয়েছ বাচ্চা মেয়ের খেয়াল। ব্যাপারটা কিন্তু তা না মা। তোমরা মাঝে মাঝে চাপা গলায় কুৎসিত ঝগড়া করতে। ঝগড়ার মূল কারণ ধরতে পারতাম না। শুধু বুঝতাম রহস্যময় একটা ব্যাপার। তুমি বিয়ের আগে ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করেছিলে। সে অন্যায় চাপা দিয়ে বাবাকে বিয়ে করেছ। প্রতারণা করেছ। লোক লজ্জার ভয়ে বাবা সেই অন্যায় হজম করছেন। আবার হজম করতে পারছেন না। পাঁচ বছরের একটা মেয়ের বাবা মার ঝগড়া থেকে সেই অন্যায় ধরতে পারার কোনো কারণ নেই। আমি ধরতে পারি নি। তবে স্মৃতিতে সব জমা করে রেখেছি। একসময় আমার বয়স বেড়েছে। আমি একের সঙ্গে এক মিলিয়ে দুই করতে শিখেছি। তারপর হঠাৎ বুঝতে পেরেছি। বিয়ের আগে আগে তোমার একটা এবোরসান হয়েছিল। কাঁটা সরিয়ে তুমি বিয়ে করেছ। বিয়ের পর দুজনে দুজনকে ভালোবাসার প্রবল ভান করেছে। আমি অবাক হয়ে তোমাদের দুজনের ভালোবাসাবাসির ভান দেখতাম। মনে মনে হাসতাম। হাসির শব্দ যেন তোমরা শুনতে না পাও সে জন্য উঁচু ভলুমে গান ছেড়ে দিতাম।