কিছু না।
তিনি খাট থেকে নামলেন। নাজমুল সাহেব বললেন, এক ফোঁটা ঘুম আসছে। কী করি বলো তো? দশটা থেকে শুয়ে আছি। এখন বাজছে তিনটা।
রওশন আরা বললেন, বয়স হয়েছে, এখন তো ঘুম কমবেই ঘুমের ওষুধ খাবে?
দাও।
রওশন আরা স্বামীকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলেন। তিনি বিছানায় ফিরে আসছেন না, বারান্দার দিকে যাচ্ছেন। নাজমুল সাহেব বললেন, যাচ্ছ কোথায়? রওশন আরা নিচু গলায় বললেন, স্বাতীকে দেখে আসি।
রাত দুপুরে চুরি করে মেয়ের ঘরে ঢোকা ঠিক না। প্রাইভেসির একটা ব্যাপার আছে। মা হলেই যে প্রাইভেসি নষ্ট করার অধিকার হয় তা কিন্তু না।
রওশন আরা শীতল গলায় বললেন, এটা কোর্ট না। আইনের কচকচানি বন্ধ রাখো। ঘুমানোর চেষ্টা কর।
রওশন আরা একটু আগে যে স্বপ্ন দেখেছেন বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। স্বপ্নের যুবকটি তার পাশে এসে বসায় তিনি যে আনন্দ পেয়েছেন–পঁচিশ বছর এই মানুষটির সঙ্গে বাস করার সব আনন্দ যোগ করেও তার সমান হবে না। স্বপ্ন ও বাস্তব এত আলাদা কেন?
স্বাতীর ঘর অন্ধকার। সে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে নি। মিউজিক সেন্টার নিঃশব্দ। রওশন আরা মেয়ের বিছানার দিকে চুপি চুপি এগুলেন। মেয়ের গায়ে চাদর আছে। আজ অবশ্যি গরম পড়েছে। গায়ে চাদর না থাকলেও চলত। মেয়েটা অদ্ভুত হয়েছে, যেদিন ঠাণ্ডা পড়ে সেদিন তার গায়ে চাদর থাকে না। গরমের সময় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমায়। রওশন আরা ঘরের জানালার দিকে তাকালেন। জানালা খোলা। বৃষ্টি এলে খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসবে। মেয়েটার বিছানাটা জানালা থেকে একটু সরিয়ে দিতে হবে। রোজ রাতেই একবার করে ভাবেন। দিনে মনে থাকে না।
তিনি ঘর ছেড়ে বেরুতে যাবেন তখন স্বাতী পাশ ফিরল। শান্ত গলায় বলল, মা তোমার ইন্সপেকশন শেষ হয়েছে?
রওশন আরা লজ্জিত গলায় বললেন, তুই জেগে ছিলি?
তুমি যতবার এসেছ ততবারই আমার ঘুম ভেঙেছে। আমি ঘুমের ভান করে তোমার কীর্তিকলাপ দেখছি। আজ ঠিক করেছিলাম হাউ করে একটা চিৎকার দিয়ে তোমাকে ভয় দেখাব।
রওশন আরা লজ্জিত গলায় বললেন, আমি যে রাতে এসে তোকে দেখে যাই তোর খুব রাগ লাগে, তাই না?
মাঝে মাঝে খুব রাগ লাগে, আবার মাঝে মাঝে এত ভালো লাগে যে বলার না।
আজ রাগ লাগছে না–ভালো লাগছে?
খুব ভালো লাগছে। আজ আমার ঘুমই আসছিল না। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কখন তুমি আসবে। মা, আমার পাশে এসে বসো। তোমার যদি ঘুম না পেয়ে থাকে তাহলে আমার সঙ্গে গল্প করো।
রওশন আরা মেয়ের বিছানায় বসলেন। স্বাতী বলল, পা তুলে আরাম করে বসো।
রওশন আরা বললেন, বাতি জ্বালা। অন্ধকারে কী গল্প করব? মুখ না দেখে গল্প করে মজা নেই।
বাতি জ্বালাতে হবে না। অন্ধকারের গল্পের আলাদা মজা আছে। সহজে গল্প করা যায় আলোতে এত সহজে গল্প করা যায় না।
বেশ অন্ধকারেই তোর গল্প শুনি। কী গল্প বলবি?
শুধু আমি একা গল্প করব কেন? দুজনে মিলে করব। আমি কিছুক্ষণ গল্প করব। তুমি কিছুক্ষণ করবে। লিলির মহা বিপদের গল্প শুনবে মা?
বলো শুনি।
ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আগামী শুক্রবার জুমা নামাজের পর পবিত্র শুভ বিবাহ।
এতে বিপদের কী হলো? বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
ওর বিয়েটা অবিশ্য খুব স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না। বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সবাই ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। লিলি যে খুব আপত্তি করছে তা না। দিব্যি মায়ের সঙ্গে গয়নার দোকানে গিয়ে গয়নার অর্ডার দিয়ে এসেছে।
ভালোই তো!
ঝটপট তার বিয়ে কেন দিয়ে দিচ্ছে জানো মা?
না।
তার বাবা-মার ধারণা হয়েছে মেয়ে তাদের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। একদিন তাকে দেখা গেছে ছাদে তার বান্ধবীর সঙ্গে সিগারেট খাচ্ছে। তারপরে সে আরেকটা ভয়াবহ অন্যায় করল, নিষেধ সত্ত্বেও ইউনভার্সিটিতে গেল। বাসায় ফিরল রাত দশটায়। এই গুরুতর অপরাধে তার শাস্তি হয়েছে–যাবজ্জীবন স্বামীর হাতে বন্দী।
তোর কি ধারণা স্বামীরা বন্দী করে ফেলে?
সব স্বামী হয়তো করে না। তখন সংসার বন্দী করে ফেলে। ছেলেমেয়ে জন্মায়–তারা বন্দী করে ফেলে। আমার বন্দী হতে ইচ্ছে করে না।
তোকে তো আর কেউ জোর করে বন্দী করতে চাচ্ছে না। কাজেই দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে বন্দী জীবনেও আনন্দ আছে।
স্বাতী শান্ত গলায় বলল, তুমি যে বাবার সঙ্গে বাস করছ, ধরাবাঁধা একটা জীবনযাপন করছ, রাধছ-খাচ্ছ-ঘুমুচ্ছ, আবার রান্না, আবার খাওয়া, আবার ঘুমানো–এই জীবনটা তোমার পছন্দের? আমার তো মনে হয় দারুণ একঘেঁয়ে একটা জীবন।
এক ঘেঁয়েমি তো সব জীবনেই আছে। তুই যদি একা বাস করিস, সেই একার জীবনেও তো এক ঘেঁয়েমি চলে আসবে।
দুজনের জীবনের এক ঘেঁয়েমি অনেক বেশি। দুজনেরটা একসঙ্গে যুক্ত হয়ে। একঘেঁয়েমি ডাবল হয়ে যায়।
তোর যত অদ্ভুত কথা!
মোটেই অদ্ভুত কথা না। আমি খুব ইন্টারেস্টিং একটা জীবন চাই মা। আমি একা থাকব। কিন্তু আমার একটা সংসার থাকবে। আমার একটা মেয়ে থাকবে। মেয়েটাকে সম্পূর্ণ আমার মতো করে আমি বড় করব। সে হবে আমার বন্ধুর মতো। আমার মতো স্মার্ট একটা মেয়ে সে হবে। খানিকটা জাহিনের মতো।
জাহিন কে?
স্বাতী একটু থতমত খেয়ে বলল, তুমি চিনবে না মা। একজন আর্টিস্টের মেয়ে।
স্বাতী চুপ করে গেল। রওশন আরাও চুপ করে রইলেন।কসময় তিনি নিচু গলায় বললেন, কোন আর্টিস্ট, যে তোর ছবি এঁকেছে?