জাহেদুর রহমান বলল, একটা থার্মোমিটার আর জ্বর কমাবার জন্য প্যারাসিটামল সিরাপ জাতীয় কিছু নিয়ে আসি।
হাসনাত বিনীত ভঙ্গিতে বলল, এনে দিলে খুব ভালো হয়। সো কাইন্ড অব ইউ। একটু দাঁড়ান আমি আপনাকে টাকা এনে দিচ্ছি।
টাকা পরে দেবেন।
জাহেদুর রহমান ব্যস্ত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেল। জ্বর এক শ তিন পয়েন্ট পাঁচ।
হাসনাতের মুখ শুকিয়ে গেল। জাহেদুর রহমান বলল, আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না। বাচ্চা ছেলেমেয়ের এক শ তিন/চার জ্বর কোনো জ্বরই না। ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। এক্ষুনি এ্যাকশান শুরু হবে। মাথায় পানি ঢালতে হবে। নন স্টপ পানি ঢেলে জ্বর যদি আধ ঘণ্টার মধ্যে এক শতে নামিয়ে আনতে না পারি তাহলে আমার নাম জাহেদুর রহমান না, আমার নাম হামেদুর রহমান। বালতি কোথায় বলুন দেখি? রবার ক্লথ আছে? না থাকলে নাই। নো প্রবলেম, ব্যবস্থা করছি।
হাসনাত অবাক হয়ে দেখল এই নিতান্ত অপরিচিত ভদ্রলোক নিজেই ছোটাছুটি করে পানি ঢালার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। তার মধ্যে কোনো রকম দ্বিধা নেই। কৃতজ্ঞতাসূচক কিছু এই ভদ্রলোককে বলা উচিত। হাসনাতের মুখে কোনো কথা আসছে না। না আসাই ভালো। এই জাতীয় মানুষ কৃতজ্ঞতাসূচক কিছু শোনার জন্য কাজ করেন না।
হাসনাত মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কেমন লাগছে মা?
এখন ভালো লাগছে। বাবা, তোমার না কোথায় যাবার কথা।
তোকে এভাবে রেখে যাব কীভাবে?
উনি তো আছেন। তোমার জরুরি কাজ, তুমি যাও।
জাহেদুর রহমান বলল, সিরিয়াস জরুরি কাজ থাকলে কাজ সেরে আসুন। আমি আছি। জ্বর নিয়ে চিন্তা করবেন না। জ্বর এর মধ্যে দুই ডিগ্রি নামিয়ে ফেলেছি। আরও নামাব। মাপুন তো দেখি জ্বরটা আরেকবার।
আবার জ্বর মাপা হলো। সত্যি সত্যি জ্বর দুডিগ্রি নেমে গেছে। এখন এক শ এক পয়েন্ট পাঁচ।
হাসনাত লজ্জিত গলায় বলল, আপনার কাছে মেয়েটাকে রেখে এক ঘণ্টার জন্য কি যাব? আমার যাওয়া খুব জরুরি। একজন অপেক্ষা করে থাকবে। রাতে ডিনারের নিমন্ত্রণও ছিল। ডিনার-টিনার না, আমি শুধু খবরটা দিয়ে চলে আসব।
আপনি চলে যান। মেয়েকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। তারপরেও হাসনাত ইতস্তত করছে। জাহিন বলল, বাবা তুমি যাও। আমি উনার সঙ্গে গল্প করব। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
হাসনাত খুব মন খারাপ করে বের হলো।
জাহিন বলল, আপনার নিশ্চয়ই পানি ঢালতে ঢালতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে। হয় নি?
উহুঁ।
আর পানি ঢালতে হবে না। আমার জ্বর এখন কমে গেছে।
আরও দশ মিনিট পানি ঢালব তারপর রেস্ট নেব। তোমার মা কোথায় গেছেন?
জাহিন লজ্জিতস্বরে বলল, আমি যখন ছোট তখন মা মারা গেছেন।
জাহেদুর রহমান প্রশ্নটা করে লজ্জায় পড়ে গেল। ঘটনা এ-রকম জানলে সে এই প্রশ্ন করত না।
জাহিনের চোখে এই মানুষটার অস্বস্তি ধরা পড়েছে। জাহিনেরও খারাপ লাগছে। জাহিন বলল, সত্যি কথাটা আপনাকে বলি মা আসলে বেঁচেই আছে। বাবার সঙ্গে রাগ করে মা আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। অন্য একটা লোকের সঙ্গে গিয়েছিল। সেটা তো খুব লজ্জার ব্যাপার এইজন্য মার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে আমরা দুজনই মিথ্যা কথা বলি। বাবা যখন মিথ্যা বলে তখন বাবার পাপ হয়। বড়দের মিথ্যা বললে পাপ হয়। আমি যখন মিথ্যা বলি তখন পাপ হয় না। আমার বয়স তো বারোর নিচে, এইজন্য পাপ হয় না। বারো বছরের নিচের কেউ মিথ্যা কথা বললে পাপ হয় না কেন সেটা জানেন?
না।
বারো নিচের সব ছেলেমেয়ে হলো ফেরেশতা। এজন্য তাদের পাপ হয় না। তবে পাপ না হলেও যখন মিথ্যা করে বলি মা মারা গেছে তখন খুব কষ্ট হয়।
জাহেদুর রহমানে চোখে পানি চলে এসেছে। সে চোখের পানি আড়াল করার জন্য মাথায় পানি ঢালা বন্ধ রেখে বারান্দায় চলে গেল।
.
সব জায়গায় সব পোশাকে যাওয়া যায় না। গ্রামের হাটে থ্রি পিসস্যুট পরে হাঁটলে নিজেকে সঙের মতো রাগবে। আবার সোনারগাঁও হোটেলে আধ ময়লা শার্ট (যার অর্ধেকটা ভেজা এবং বুকের কাছে নীল রং লেগে আছে) বেমানান। হাসনাত লক্ষ করল সবাই তাকে দেখছে। ভুরু কুঁচকাচ্ছে না, কারণ সভ্য মানুষ ভুরু কুঁচকায় না। কুঁচকালেও তা চোখে পড়ে না।
হোটেলের রিসেপশনিস্ট অবশ্যি স্পষ্টতই ভুরু কুঁচকালো। প্রায় অভদ্রের মতোই বলল, কাকে চান?
রুবি। রুবি হক। রুম নং তিন শ চার।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
আছে।
দাঁড়ান, জিজ্ঞেস করে দেখি।
জিজ্ঞেস করে দেখি বলেও সে দেখছে না। হাতের কাজ সারছে। ভেজা শার্টের একটা মানুষকে অপেক্ষা করানো যায়। এক সময় রিসেপশনিস্টের দয়া হলো। ইন্টারকমে জিজ্ঞেস করল।
যান, সিঁড়ি দিয়ে চলে যান। সেকেন্ড ফ্লোর। ম্যাডাম যেতে বলেছেন।
ধন্যবাদ।
রিসেপশনিস্ট ধন্যবাদের জবাব দিল না। বড় হোটেলের কর্মচারীদের এটিকেট শেখার জন্য দীর্ঘ ট্রেনিং নিতে হয়। তবে সেই এটিকেট সবার জন্য না।
.
ডোর বেলে হাত রাখতেই ভেতর থেকে শুদ্ধ এবং পরিষ্কার ইংরেজিতে বলা হলো, Door is open, come in please. হাসনাত ঘরে ঢুকল। রুবি চেয়ারে বসে ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, এসো ভেতরে এসো। জাহিন কোথায়?
ও আসে নি। শরীর ভালো না। জুর।
আমার তো মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই আন নি।
হাসনাত শান্ত গলায় বলল, রুবি, আমি কখনও ট্রিকস করি না।
সরি I know that. বসো।
রুবিকে দেখে চমকের মতো লাগছে। তার চেহারা পাল্টে গেছে। খাড়া নাক। ঠোঁটের কোথায় যেন কি একটা পরিবর্তন হয়েছে, সূক্ষ্ম পরিবর্তন। যেহেতু পরিবর্তনটা ঠোঁটে সেহেতু ছোট পরিবর্তনও বড় হয়ে চোখে লাগছে। শাড়ি পরেছে। সেই শাড়ি পরাতেও কিছু আছে। ঠিক বাঙালি মেয়ের শাড়ি পরা বলে মনে হচ্ছে না।