গভীর মনোযোগে হাসনাত কাজ করছে। ব্রাশের কাজ শুরু হয়েছে। এরং রঙ ব্যবহার করা হবে–নীল। নীলের সঙ্গে শাদা মিশিয়ে নানান ধরনের কে ছবির বিষয়বস্তু সাধারণ। ছাদে শাড়ি শুকাতে দিয়েছে একটা মেয়ে। দড়িতে শায়া মেলছে। ভেজা শাড়ি থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। যে আকাশ ঘন নীল। রঙের ধর্ম হলো রঙ এক জায়গায় স্থির থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে। আকাশের নীল ছড়িয়ে পড়েছে ছাদে, ভেজা শাড়িতে, শাড়ির গা থেকে গড়িয়ে পড়া পানির ধারায়। রঙকে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়ার এই প্রক্রিয়াটিই সবচেয়ে জটিল প্রক্রিয়া। সমস্ত ইন্দ্রিয় এই প্রক্রিয়ার সময় সূঁচের মতো তীক্ষ্ণ করে রাখতে হয়। সাধকের একাগ্রতা তখনই প্রয়োজন হয়।
হাসনাত হাজার চেষ্টা করেও মন বসাতে পারছে না। বারবার সুতা কেটে যাচ্ছে। যদিও তার আপাতত কোনো কারণ নেই। জাহিন বিরক্ত করছে না। সে ঘরে আছে কি ঘরে নেই তাও বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে গল্পের বই নিয়ে মগ্ন। স্টুডিওর দরজা-জানালা বন্ধ। বাইরের আওয়াজ কানে আসছে না। ইজেলের উপর আট শ ওয়াটের আলো ফেলা হয়েছে। তেমন আলো হয় নি, ঘর গরম হয়ে গেছে।
হাসনাত শার্ট খুলে ফেলল। গরমের কারণেই কি বারবার তার একাগ্রতায় বাধা পড়ছে? না-কি অন্য কিছু স্টুডিওতে ফ্যান নেই। ফ্যানের শব্দে তার অসুবিধা হয়। তাছাড়া ফ্যান রঙে মেশানো তাৰ্পিন তেল দ্রুত উড়িয়ে নেয়। এই ঘরে দামি একটা এয়ারকুলার ফিট করা থাকলে ভালো হতো। ঘরটা এস্কিমোদের ইগলুর মতো ঠাণ্ডা হয়ে থাকবে। সেই হিম হিম পরিবেশে সে কাজ করবে। হাত চলবে যন্ত্রের মতো। আজ হাত চলছে না। মনে হচ্ছে হাতের মাংসপেশিতে টান পড়ছে। এক শ মিটার দৌড়ের শেষ মাথায় যখন কোনো খেলোয়াড়ের পায়ের মাংসপেশিতে টান পড়ে, দুহাতে পা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে সে তাকায় অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে। হাসনাত এখন ঠিক সেই দৃষ্টিতেই তার হাতের দিকে তাকাচ্ছে।
বাবা!
হাসনাত হাতের ব্রাশ নামিয়ে রেখে মেয়ের দিকে তাকাল। তার মুখের দিকে তাকাল না, তাকাল পায়ের দিকে। মুখের দিকে তাকালে মেয়েটা মন খারাপ করবে। সে তার বাবার রাগ বুঝে ফেলবে। হাসনাত বলল, স্যান্ডউইচ খেয়েছ মা?
না।
খেলে না কেন? ভালো হয় নি?
আমার খেতে ইচ্ছা করছে না বাবা।
একটা কলা খাও।
কলা খেতেও ইচ্ছে করছে না।
তাহলে শুয়ে শুয়ে গল্পের সই পড়ো। ঠিক যখন পাঁচটা বাজবে, আমাকে ডেকে দেবে।
পাঁচটা বাজে।
পাঁচটাতো বাজে, বলো কি? তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও। খুব তাড়াতাড়ি। আমরা এক জায়গায় বেড়াতে যাব। তারপর রাতে বাইরে খাব খাওয়া-টাওয়া শেষ হবার পর ফেরার পথে আইসক্রিম কিনে দেব।
আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না বাবা। শরীর খারাপ লাগছে।
যখন বেড়াতে যাব তখন আর শরীর খারাপ লাগবে না। মন খারাপ থাকলেই শরীর খারাপ হয়। মন যখন ভালো হবে তখন আপনা আপনি শরীর ভালো হবে।
বাবা, একজন ভদ্রলোক এসেছেন। আমি তাকে বারান্দায় চেয়ারে বসিয়ে রেখেছি।
ভালো করেছ। দাঁড়াও তার সঙ্গে কথা বলছি। তুমি তৈরি হয়ে নাও তো মা। তোমার যে পরী পরী ধরনের শাদা ফ্রকটা আছে ঐটা পরো।
আমার একদম যেতে ইচ্ছা করছে না বাবা।
কাপড় পরো তারপর দেখবে যেতে ইচ্ছা করবে।
জাহিন দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। হাসনাত শার্ট গায়ে দিয়ে উঠে এল, মেয়ের হাত ধরে সে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল। জ্বরে জাহিনের গা প্রায় পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর নিয়ে মেয়েটা যে তার সঙ্গে কথা বলছে, সহজভাবে দাঁড়িয়ে আছে এটাই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।
মা, তোমার শরীর তো খুবই খারাপ।
হুঁ।
এসো শুইয়ে দি।
হাসনাত কোলে করে মেয়েকে নিয়ে শুইয়ে দিল। ওয়ার্ডরোব খুলে মেয়ের গায়ে কম্বল দিল। জ্বর কমানোর জন্য মেয়েকে এনালজেসিক কিছু খাওয়ানো দরকার। ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসতে হবে। সোনারগাঁও হোটেলের এ্যাপয়েন্টমেন্টটা কিছুতেই মিস করা যাবে না। হাসনাত কি করবে ধাঁধায় পড়ে গেল। জাহিন বলল, বাবা একজন ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় বসে আছেন।
আচ্ছা আমি উনাকে বিদায় করে আসছি। তোর হুট করে এত জ্বর উঠে গেল কীভাবে?
জাহিন হাসল। লজ্জার হাসি। যেন হুট করে জ্বর ওঠায় সে খুব বিব্রত ও লজ্জিত।
বারান্দা যিনি বসে আছেন হাসনাত তাকে চিনল না। স্মার্ট পোশাকের এক ভদ্রলোক, তবে গলায় সোনার চেইন চকচক করছে। সোনার চেইনের কারণে যে ভদ্রলোকের সব স্মার্টনেস ধুয়েমুছে গেছে তা তিনি জানেন না।
আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।
আমার নাম জাহেদুর রহমান। আমি লিলির ছোট চাচা।
কিছু মনে করবেন না। আমি এখনও চিনতে পারছি না।
লিলি! ও আপনার এখানে এসেছিল। একটা শাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। ফেরত পাঠিয়েছে আর জাহিনের জন্য একটা গল্পের বই পাঠিয়েছে।
ও আচ্ছা আচ্ছা, লিলি! আমার মেয়েটার হঠাৎ খুব জ্বর এসেছে। আমার নিজের মাথা গেছে এলোমেলো হয়ে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। প্লিজ।
না না, মনে করব কি? জ্বর কত?
জ্বর যে কত তাও তত বলতে পারছি না। ঘরে থার্মোমিটার নেই।
আমি কি একটা থার্মোমিটার কিনে নিয়ে আসব?
হাসনাত জাহেদুর রহমানের দিকে তাকিয়ে আছে। গলায় সোনার চেইনের কারণে শুরুতে ভদ্রলোককে যতটা খারাপ লাগছিল এখন ততটা খারাপ লাগছে না। মানুষের চেহারা তার আচার-আচরণের ওপরও নির্ভরশীল। চিত্রকর ছবিতে চেহারা ধরতে পারেন। আচার-আচরণ ধরতে পারেন না। সবাই যে পারেন না, তা না। মহান চিত্রকরদের কাউকে কাউকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।