উনি একাই থাকেন। মাঝে মাঝে তার মেয়ে এসে থাকে।
তাঁর স্ত্রী কোথায়?
বোধহয় মারা গেছেন।
বোধহয় বলছিস কেন?
উনার মেয়েটা বলছিল মারা গেছেন। আমার তা মনে হয় নি। আমার মনে হয়েছে ভদ্রলোক ডিভোর্সড়!
তুই কি প্রায়ই ঐ বাড়িতে যাস?
আগে একবার গিয়েছিলাম।
তোর মা বলছিল অন্য কার একটা শাড়ি পরে তুই ফিরেছিস।
বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে গিয়েছিল সে জন্য বদলেছি।
নেয়ামত সাহেব চুপ করে আছেন। লিলি অবাক হয়ে লক্ষ করল বাবা এখন আর তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছেন না। চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন। তাঁর হাতের সিগারেট অনেক আগেই নিভে গেছে। তিনি নেভা সিগারেটেই টান দিচ্ছেন। লিলি বলল, বাবা সিগারেট নিভে গেছে।
নেয়ামত সাহেব লিলির এই কথাতেও চমকালেন। সিগারেট ধরালেন না। নেভা সিগারেটে আবার টান দিলেন। লিলি বলল, বাবা আমি যাই।
নেয়ামত সাহেব হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। লিলি বাবার সামনে থেকে উঠে এলো। তিনি অদ্ভুত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
লিলির খিদে পেয়েছে। নাশতার জন্য নিচে নামতে তার ইচ্ছা করছে না। সে ছাদে উঠে গেল। ছোট চাচার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। সহজভাবে কিছুক্ষণ কথা বলবে। হাসি-তামাশা করবে।
জাহেদুর রহমান জুতা পলিশ করছিল। সে লিলির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, তোর জন্য কাল আমার যে যন্ত্রণা হয়েছে। রাত দুপুরে খাসি কিনতে গেছি আমিনবাজার। ঠেলে ঠুলে দুটিকে বেবিট্যাক্সিতে তুললাম। এরা সারাপথ কী চিৎকার যে করেছে! ভাবটা এ-রকম যেন আমি এদের চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। পিঠে আদর করি, গলা চুলকে দেই–কিছুতেই কিছু হয় না, ভ্যা ভ্যা। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে পুলিশ বক্সের কাছে পুলিশ এসে ধরল।
কেন?
আমারও প্রশ্ন, কেন? আমি তো ইন্ডিয়ান গরু স্মাগল করে আনি নি। আমি এনেছি খাঁটি বঙ্গদেশীয় ছাগল।
তারপর?
আমি যে নগদ পয়সায় ছাগল কিনেছি পুলিশ বিশ্বাস করে না। বলে রসিদ দেখান। আরে ছাগলের আবার রসিদ কি? এটা কি টিভি যে রসিদ নিয়ে আসব লাইসেন্স করাতে হবে?
শেষে কী করলে?
পান খাওয়ার জন্য পঞ্চাশটা টাকা ধরে দিলাম। আর মনে-মনে তোকে এক লক্ষ গালি দিলাম। কাল তুই কোথায় ছিলি? বান্ধবীর বাসায় লুকিয়ে ছিলি?
লিলি হাসল।
জাহেদুর রহমান বলল, আমিও ভাইজানকে তাই বললাম। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ের দৌড় হলো বান্ধবীর বাড়ি পর্যন্ত। ভাইজান আমার কথা বিশ্বাস করল না–এমন হইচই।
তোমার আমেরিকা যাবার নতুন কিছু হয়েছে?
বৃহস্পতিবার আবার ইন্টারভ্যু দিচ্ছি। মরমন পাদ্রি কথা দিয়েছে সাহায্য করবে। কাকে নাকি বলে দেবে।
তুমি কি খ্রিস্টান হয়ে গেছ?”
এখনও হই নি। ব্যাটার নাকের সামনে মুলা ঝুলিয়ে রেখেছি। একবার খ্রিস্টান হয়ে গেলে তো আর পাত্তা দেবে না। ঠিক না?
হুঁ।
দেশ ছেড়ে দেবার এখন হাই টাইম। ভেরি হাই টাইম।
কেন?
খবর কিছু জানিস না।
না।
বড় ভাইজান ভোম মেরে বসে আছে সেটা দেখেও কিছু বুঝতে পারছিস না?
না।
আমাদের সৎ মা দি গ্রেট লেডি মোসাম্মত আফরোজা বেগম যার নামে আমাদের এই বাড়ি রহিমা কুটির তিনি তাঁর বাড়ি ফেরত চেয়েছেন।
তাই নাকি?
হা। মুখের কথায় চাওয়া না, উকিলের চিঠিফিঠি পাঠিয়ে বেড়াছেড়া। বড় ভাইজানের পালপিটিশন শুরু হয়ে গেছে। ক্রমাগত ঠাণ্ডা পানি খাচ্ছে আর বাথরুমে যাচ্ছে।
আমাদের এখন হবে কী?
হবে আবার কি? তোরা কমলাপুর রেল স্টেমনের প্ল্যাটফরমে শুয়ে থাকবি।
তুমি মনে হচ্ছে ব্যাপারটায় খুশি?
আমার অখুশি হবার কি আছে। আমি তো আর দেশে থাকছি না। তুইও থাকছিস না।
আমি যাব কোথায়?
তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না? কে নাকি আজ সন্ধ্যায় তোক দেখতে আসবে। মেয়ে হয়ে জন্মানোর ডিসএ্যাডভানটেজ যেমন আছে, এ্যাডভানটেজও আছে। বিপদের সময় অন্যের গলা ধরে ঝুলে পড়ার সুযোগ আছে।
জাহেদুর রহমান প্রবল বেগে জুতা ব্রাশ করছে। বৃহস্পতিবারের ভিসা ইন্টারভ্যুর প্রস্তুতি।
.
সন্ধ্যাবেলা গোঁফওয়ালা এক ছেলে সত্যি সত্যি বাসায় এসে উপস্থিত। তার গা দিয়ে সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। বর্তমান কালের স্টাইলে শার্টের সামনে দুটি বোতাম খোলা। শরীরের তুলনায় তার মাথাটা ছোট এবং মনে হয় স্প্রিং বসানো। সারাক্ষণ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
ফরিদা সেমাই রান্না করতে বসেছেন। মতির মাকে টাকা দিয়ে পাঠানো হয়েছে মিষ্টি আনতে।
লিলি এসে মার পাশে দাঁড়াল। সহজ গলায় বলল, মা ছেলেটাকে দেখেছ?
ফরিদা চোখ না তুলেই বললেন, হুঁ।
ছেলেটাকে তোমার কেমন লাগছে মা?
ভালোই তো।
বেশ ভালো, না মোটামুটি ভালো?
বেশ ভালো। তবে চোখ দুটো ভালো না। রুমু ঝুমুর মাস্টারের মতো। শকুন শকুন চোখ।
তার জন্য চা নিয়ে কি আমাকে যেতে হবে?
হুঁ।
এই শাড়ি পরে যাব, না ভালো কোনো শাড়ি পরব?
সবুজ শাড়িটা পর। রুমুকে বল চুল বেণি করে দিতে।
আচ্ছা।
লিলি বলল, মা তোমার কাছে মনে হচ্ছে না, ছেলেটার মাথা শরীরের তুলনা
ছোট?
ফরিদা চুলায় ডেকচি বসাতে বসাতে বললেন, ভারী জামা-কাপড় পরেছে তে। এইজন্য মাথাটা ছোট লাগছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলে দেখবি মাথা ঠিকই লাগছে।
লিলি হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। ফরিদা লিলির হাসির কারণ ঠিক ধরতে পারছেন না।
হাসনাত সকাল থেকেই স্টুডিওতে
হাসনাত সকাল থেকেই স্টুডিওতে। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য বের হয়েছিল। প্যাকেট করে স্যান্ডইইচ এবং দড়িতে বেঁধে এক ডজন কলা দিয়ে ফিরেছে। জাহিনকে বলেছে, মা খেয়ে নাও তো। রাতে আমরা খুব ভালো কোনো জায়গায় খাব। হোটেল সোনারগাঁও, কিংবা শেরাটন এই জাতীয় জায়গায়। বলেই সে অপেক্ষা করেনি। স্টুডিওতে ঢুকে পড়েছে। জাহিন স্টুডিওর দরজা ধরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা, তুমি কিছু খাবে না। হাসনাত কিছু বলল না। কিন্তু তাকাল বিরক্তমুখে। যে বিরক্তির অর্থ–খবরদার আর ডাকাডাকি করবে না।