চিড়িয়াখানায় বাঁদর দেখতে হবে কেন?
বাঁদরের জন্যই তো মানুষ হয়ে জন্মাতে পেরেছি। এজন্য বাঁদরদের থ্যাংকস দিয়ে আসব।
রওশন আরা স্বস্তিবোধ করছেন। স্বাতী স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে। তিনি চঠি হাতে নিচে নামছেন। স্বাতী আগের পরিকল্পনা ভুলে গিয়ে মার পেছনে নেমে আসছে। সিঁড়ি পর্যন্ত আসতেই নাজমুল সাহেব বললেন, মাই লিটল ড্যান্সার, আমার ছোট্ট নর্তকী, হ্যাপি বার্থ ডে। শুভ জন্মদিন।
স্বাতী সিঁড়ির মাঝামাঝি থেকে প্রায় উড়েজেসছে। নাজমুল সাহেব চট করে উঠে দাঁড়ালেন। তার এই মেয়েটার অভ্যাস হচ্ছে বেশ অনেকখানি দূর থেকে গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ছোট বেলাতেই মেয়ের এই ঝাঁপিয়ে পড়া সামলাতে পারতেন না। এখন মেয়ে বড় হয়েছে, তারও বয়স হয়েছে। তাঁর ভয় হচ্ছে মেয়েকেসুদ্ধ তিনি না গড়িয়ে পড়ে যান। মেয়েকে এভাবে ছুটে আসতে দেখলেই অনেকদিন আগের একটা ছবি তার মনে হয়।
স্বাতী তখন ক্লাস টু-তে পড়ে। স্কুলের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন অনুষ্ঠান। স্বাতী সেখানে নাচবে। সে একা না, তার সঙ্গে নটি মেয়ে আছে। নাচের নাম–এসো হে বসন্ত। তারা সবাই হলুদ শাড়ি পরেছে। মাথায় ফুলের মুকুট। গলায় ফুলের মালা।
নাজমুল সাহেব মুগ্ধ দর্শক। দর্শকদের সঙ্গে প্রথম সারিতে বসে আছেন। খুব আফসোস হচ্ছে কেন ক্যামেরা নিয়ে এলেন না। নাচের শুরুতেই একটা ঝামেলা হয়ে গেল–স্বাতীর মাথা থেকে ফুলের মুকুট পড়ে গেল। দর্শকরা হেসে উঠেছে। স্বাতী মুকুট কুড়িয়ে মাথায় পরার চেষ্টা করছে। অন্যরা নেচে যাচ্ছে। তিনি লক্ষ করলেন স্বাতীর চোখে পানি। সে এক হাতে পানি মুছল। তারপর মুকুটটা ঠিক করল। ঠিক করে আবার নাচ শুরু করতে গেছে–আবার মুকুট পড়ে গেল। দর্শকদের হাসির স্বরগ্রাম আরও উঁচুতে উঠল। স্বাতী আবারও মুকুট কুড়িয়ে পরতে শুরু করল। এবার মুকুটটা পড়ল উল্টো করে। নাচের চেয়ে ছোট মেয়েটির কাণ্ডকারখানায় দর্শকরা অনেক বেশি মজা পাচ্ছে। তাদের হাসি আর থামছে না। স্বাতী কাঁদছে। সে চোখের পানি মুছে আবার নাচতে গেল। ততক্ষণে নাচ শেষ হয়ে গেছে। স্বাতী বাবার দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় ডাকল, বাবা!
নাজমুল সাহেব স্টেজের দিকে এগিয়ে এলেন আর তখন এই মেয়ে আচমকা স্টেজ থেকে তাঁর উপর লাফিয়ে পড়ল। তিনি এই ধাক্কা সামলাতে পারলেন না। মেয়েকে নিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।
আজও মেয়ে সেদিনের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ল। আজও তিনি সেদিনের মতোই গাঢ় গলায় বললেন, মাই লিটল ড্যান্সার। মাই লিটল ড্যান্সার। আমার ছোট্ট নর্তকী হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
রওশন আরার একটু মন খারাপ রাগছে। কারণ, ঝাঁপিয়ে পড়ার এই ব্যাপারটি স্বাতী শুধু তার বাবার সঙ্গেই করে। তাঁর সঙ্গে করে না।
তিনি চিঠি হাতে ড্রাইভারে খোঁজে গেলেন। ড্রাইভার এখনও আসে নি। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ছুটির দিনে ড্রাইভার দশটার আগে আসে না। খাম বন্ধ চিঠি। আঠা এখনও শক্ত হয়ে লাগে নি। খাম খুলে চিঠি পড়ে দেখলে কেমন হয়? ব্যাপারটা অন্যায়। বড় ধরনের অন্যায়। তবু মাদের এসব অন্যায় করতে হয়। তিনি একটু আড়ালে গিয়ে চিঠি পড়লেন। স্বাতী লিখেছে–
প্রিয় লিলি ফুল,
আজ যে আমার জন্মদিন তোর কি মনে আছে? তুই কি পারবি আসতে? ছুটির দিনে তোকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না উঠা জানি। তবু একবার চেষ্টা করে দেখ। তোর বাবাকে বল টিউটোরিয়াল পরীক্ষার জন্য আমার সঙ্গে ডিসকাস করে পড়া দরকার। ও আচ্ছা ভুলেই গেছি তুই তো আবার সত্যবাদী! মিথ্যা বলতে পারিস না। তাহলে বরং সত্য কথাই বল। বল–আমার বান্ধবীর জন্মদিন। শুধু তাকে শুভ জন্মদিন জানিয়ে চলে আসব। মাত্র এক ঘণ্টার ভিসা দিন।
লিলি তোর আসা খুব দরকার। আমি ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করেছি। অন্যায়টা চাপা দেয়ার জন্য এখন আমাকে আরও কয়েকটা ছোটখাটো অন্যায় করতে হবে। তোর সঙ্গে আলাপ করা দরকার।
ইতি স্বাতী নক্ষত্র
রওশন আরা চিঠিটা দুবার পড়লেন। তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে খাম বন্ধ করলেন। ফিরে এলেন চায়ের টেবিলে। স্বাতী ঝলমলে মুখে কাপে চা ঢালছে। রওশন আরা বললেন, ড্রাইভার এখনও আসে নি। আজ শুক্রবার তো দশটার আগে আসবে না।
স্বাতী বলল, দশটার সময় পাঠিও। আর শোনো মা, চিঠিতে কী লেখা সেটা পড়ে তুমি এমন হকচকিয়ে গেছ কেন? ইন্টারেস্টিং কিছু না লিখলে লিলি আসবে না। ওকে আনার জন্য এসব লিখেছি।
নাজমুল সাহেব বললেন, কী নিয়ে কথা হচ্ছে?
স্বাতী বলল, বাবা তুমি বুঝবে না। মাতা ও কন্যার মধ্যে কথা হচ্ছে। মা চা দি তোমাকে?
রওশন আরা বললেন, দে।
রওশন আরা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মেয়ে তাঁকে ঠিক কথা বলে নি। কিছু-একটা হয়েছে। ভয়ঙ্কর কিছু।
লিলি ভালো ঘুমুতে পারে নি
লিলি ভালো ঘুমুতে পারে নি। তিন চার বার ঘুম ভেঙেছে। বিশ্রী বিশ্রী সব স্বপ্ন দেখেছে। একটা স্বপ্ন ছিল ভয়াবহ। তার যেন বিয়ে হচ্ছে। সেজেগুজে বিয়ের আসরে সে বসে আছে, হঠাৎ শুটকো ধরনের একটা ছেলে দৌড়ে ঢুকল। তার হাতে কয়েকটা জর্দার কৌটা। সে বলল, খবরদার কেউ নড়বে না। বোম মেরে উড়িয়ে দেব। চারদিকে কান্নাকাটি, হইচই। এর মধ্যে বোমাফাটা শুরু হয়েছে। দৌড়ে পালাতে গিয়ে দরজার কাছে হুমড়ি খেয়ে লিলি পড়ে গেছে। স্বাতী এসে তাকে তুলল। স্বাতী বলল, চল পালাই। লেট আস রান। রান বেবি রান।