গোল্ডেন টোপাজ।
পেলে কোথায় তুমি?
তোর মামাকে দিয়ে নেপাল থেকে আনিয়েছি। তোর জন্মদিনের উপহার। পছন্দ হয়েছে মা?
এত সুন্দর একটা উপহার তুমি আমাকে দেবে আমার পছন্দ হবে না। আমার তো মা মনে হচ্ছে আমি কেঁদে ফেলব।
রওশন আরা তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বললেন, কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করলে কেঁদে ফেল।
এই পাথরটা দিয়ে আমি কী করি বলতো মা?
লকেট বানিয়ে গলায় পরতে ইচ্ছা করছে?
আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে।
মেয়ের আনন্দ দেখে রওশন আরার চোখে পানি এসে গেল। এ-বছর নাজমুল সাহেব এ-রকম সুন্দর কিছু যোগাড় করেন নি তবে তার উপহারটাও কম সুন্দর না। একুশটা গোলাপ তিনি একুশ রকমের যোগাড় করেছেন। সাদা গোলাপ আছে, কালো গোলাপ আছে, ঈষৎ নীল গোলাপ আছে, একটা গোলাপ আছে ডালিয়ার মতো বড়, আর একটা তারা ফুলের চেয়েও ছোট-নাকছাবি হিসেবে নাকে পরা যায় এমন। মেয়ের চিঙ্কার এবং উল্লাস দেখবেন এই আশায় নাজমুল সাহেব পরিশ্রম করে গোলাপগুলো সংগ্রহ করেছেন। মেয়ে দরজা খোলে নি।
রওশন আরা স্বাতীর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললেন, দরজা খোল মা।
স্বাতী বলল, তোমার কাছে তো চাবি আছে তুমি খুলে ফেলো।
তোর সঙ্গে চা খাওয়ার জন্য আমরা দুজন নিচে বসে আছি।
এখন ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছা করছে না।
তোর কী হয়েছে?
দারুণ মন খারাপ লাগছে।
কেন?
জানি না কেন।
হাত-মুখ ধুয়ে নিচে আয়। ভালো লাগবে। তোর বাবা তোর জন্য একুশ রকমের গোলাপ যোগাড় করেছে। বেচারা একুশ রকমের গোলাপ যোগাড় করতে গিয়ে খুব কষ্ট করেছে। একদিনে তো সব যোগাড় হয় না। একেকটা করে যোগাড় করেছে, লবণ পানিতে ডুবিয়ে, পলিথিনে মুড়ে ডীপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছে।
আমি যদি আরও দশ বছর বাঁচি তাহলে বাবার খুব কষ্ট হবে। একত্রিশটা বিভিন্ন রকমের গোলাপ পাওয়া তো সহজ কথা না।
স্বাতী।
কী মা?
বের হয়ে আয়।
আসছি। পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না মা। তুমি বাবার কাছে যাও। আমি সেজেগুজে নিচে নামব।
নাজমুল সাহেব উদ্বিগ্ন চোখে তাকালেন। রওশন আরা বললেন, ও আসছে।
ব্যাপারটা কী?
কোনো ব্যাপার না। মন খারাপ আর কি! মানুষের মন খারাপ হয় না?
উৎসব-টুৎসবের দিন মন খারাপ বেশি হয়। তোমাকে একটু চা দেব?
না, ও আসুক।
ওর মনে হয় আসতে দেরি হবে। সেজেগুজে আসছে। তোমার তো আবার ঘুম থেকে উঠেই চা খাবার অভ্যাস।
একদিন অভ্যাসের হেরফের হলে কিছু হবে না। আমার কেন জানি দুশ্চিন্তা লাগছে। মেয়েটার কী হয়েছে বলতো?
হবে আবার কী? কিছু হয় নি। একা একা থাকে তো, এজন্যই মুডি ধরনের হয়েছে। কয়েকটা ভাইবোন থাকলে হেসে-খেলে, ঝগড়াঝাটি করে বড় হতো, তাহলে কোনো সমস্যা হতো না।
ওর বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়? স্বামীর সঙ্গে হইচই করবে, গল্প করবে, ঝগড়াঝাটি করবে। ভালো একটা ছেলে দেখে…
কোথায় পাবে ভালো ছেলে?
ভালো ছেলে পাওয়া সমস্যা তো বটেই।
একজন কাউকে ধরে আনলেই যে তোমার মেয়ের পছন্দ হবে, কে তুলল?
নাজমুল সাহেব চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লেন। নিশ্বাস ফেলে বললেন, ওর পছন্দের কেউ আছে?
না। থাকলে জানতাম। ওর পছন্দের কেউ নেই।
থাকলেও তোমাকে হয়তো সে বলবে না।
রওশন আরা বললেন, অবশ্যই বলবে। আমাকে না বলার কী আছে?
মায়েরা সব সময় একটা ভুল করে। মায়েরা মনে করে তার মেয়ে যেহেতু তার অংশ সেহেতু মেয়ে তার জীবনের সব কথা মাকে বলবে। ব্যাপারটা সে রকম না। তুমি কি তোমার সব গোপন কথা তোমার মাকে বলেছ?
প্রয়োজনের কথা সবই বলেছি।
তার পরেও অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে গেছে।
আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে তর্ক করতে ভালো লাগছে না। চুপ করে থাকো।
আচ্ছা যাও চুপ করলাম। খবরের কাগজ এসেছে?
এত সকালে তো খবরের কাগজ আসে না। তুমি শুধু শুধু জিজ্ঞেস করছ কেন?
তোমাকে রাগিয়ে দেবার জন্য জিজ্ঞেস করছি। তুমি যে কত অল্পতে রেগে যাও তা তুমি জানো না। যাতে জানতে পারে সে জন্য ছোটখাটো দুএকটা ব্যাপার করে তোমাকে রাগাই।
রওশন আরা টি-পট নিয়ে উঠে গেলেন। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। নতুন এক পট চা বানাবেন। ঘরে বেশ কয়েকজন কাজের মানুষ আছে, তারপরেও রান্নাবান্নার সব কাজ তিনি নিজে করেন। রান্নাবান্নার ব্যাপারে তাঁর সামান্য শুচিবায়ুর মতো আছে।
কুড়ি মিনিট পার হয়ে গেছে স্বাতী নিচে নামছে না। রওশন আরা আবার উঠে গেলেন। স্বাতীর ঘরের দরজা খোলা। সে সাদা ফুল দেয়া নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। চুল আঁচড়াচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি। স্বাতী বলল, মা-বাবা কি বারান্দায় বসে আছে?
হ্যাঁ।
বাবাকে চমকে দেয়ার একটা ব্যবস্থা করি। তুমি বাবাকে বলো যে, আমি বিছানায় শুয়ে কাদছি। বাবা আমার খোঁজে আসবে। এর মধ্যে আমি করব কি কোলবালিশটা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখব। মনে হবে আমি শুয়ে আছি। বাবা চাদর টেনে তুলতে যাবে আমি পেছন থেকে বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। কেমন হবে মা?
ভালোই হবে।
ড্রাইভার চাচা এসেছে মা?”
এসেছে বোধহয়।
ড্রাইভার চাচার হাত দিয়ে আমি আমার বান্ধবী লিলিকে একটা চিঠি পাঠাব। চিঠি লিখে রেখেছি। ড্রাইভার চাচার হাতে পাঠিয়ে দাও।
এখন পাঠাব? সাতটাও বাজে নি।
লিলি খুব ভোরে ওঠে মা।
আচ্ছা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
লিলিকে আসতে বলেছি। জন্মদিন উপলক্ষে আমরা দুজন সারাদিন হইচই করব। চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঁদর দেখব।