- বইয়ের নামঃ সে ও নর্তকী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
স্বাতীর দরজায় টুক টুক করে
স্বাতীর দরজায় টুক টুক করে দুবার টোকা পড়ল।
স্বাতী চাদরে মুখ ঢেকে ছিল, চাদরের ভেতর থেকেই বলল–কে? নাজমুল সাহেব দরজার বাইরে থেকে বললেন, শুভ জন্মদিন মা। স্বাতী বলল, থ্যাংক য়্যু। সে চাদরের ভেতর থেকে বের হলো না, দরজা খুলল না। নাজমুল সাহেব চলে গেলেন না। দরকার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি ফুল নিয়ে এসেছিলেন। মেয়ের একুশ বছরে পা দেয়ার জন্য একুশটা ফুল। ফুলদানিতে ফুলগুলো সুন্দর করে সাজানো। মেয়ের পড়ার টেবিলে ফুলদানি রাখবেন, মেয়ের কপালে চুমু খাবেন–এই হলো তার পরিকল্পনা। কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। স্বাতী দরজা খুলছে না। নাজমুল সাহেব আবার দরজায় টোকা দিলেন। স্বাতী বলল, আমি এখন দরজা খুলক না বাবা! সারা রাত আমার ঘুম হয় নি। আমি এখন ঘুমুচ্ছি।
ঘুমুচ্ছিস না, তুই জেগে আছিস। দরজা খুলে দে।
না। তুমি তোমার গিফট দরজার বাইরে রেখে যাও।
ইজ এনিথিং রং মা?
নো। নাথিং ইজ রং।
নাজমুল সাহেব উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। নাথিং ইজ রং বলার সময় তার মেয়ের গলা কি ভারী হয়ে গেছে? গলাটা কাঁদো-কাঁদো শুনিয়েছে? তিনি চিন্তিত মুখে ফুলদানি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। তাকে এবং তাঁর গোলাপগুলোকে লজ্জিত বলে মনে হচ্ছে।
একতলার বারান্দায় স্বাতীর মা রওশন আরা বসে আছেন। ছোট্ট নিচু টেবিলের তিন দিকে তিনটা বেতের চেয়ার। মেয়ের জন্মদিনের ভোরবেলা একসঙ্গে চা খাওয়া হবে। তার সামনে টি-পট ভর্তি চা। ঠাণ্ডা যেন না হয় সে জন্য টি-কোজি দিয়ে চায়ের পট ঢাকা। টি-কোজিটা দেখতে মোরগের মতো। যেন ট্রের উপর একটা লাল মোরগ বসে আছে। মোরগটা এত জীবন্ত–মনে হয় এক্ষুনি বাগ দেবে। তার গায়ের পালক, সত্যিকার পালকে তৈরি। তার পুঁতির লাল চোখ সত্যিকার চোখের মতোই জ্বলে। এই মোরগ রওশনের আরার খুব পছন্দ। শুধু বিশেষ বিশেষ দিনেই তিনি মোরগটা বের করেন। আজ একটা বিশেষ দিন–তার মেয়ে একুশে পা পিয়েছে। তার জন্ম এপ্রিলের চার তারিখ ভোর ছটা দশ। এখন বাজছে ছটা কুড়ি।
নাজমুল সাহেবকে ফুলদানি হাতে ফিরে আসতে দেখে রওশন আরা অবাক হয়ে তাকালেন। নাজমুল সাহেব বিব্রত মুখে বললেন, ও ঘুমুচ্ছে।
রওশন আরা বললেন, ঘুমুবে কেন? একটু আগেই তো শুনলাম গান বাজছে?” রাতে ঘুম হয় নি। এখন বোধহয় শুয়েছে।
রওশন আরার ভুরু কুঁচকে গেল। রাতে ঘুম হয় নি কথাটা ঠিক না। তিনি রাতে একবার মেয়ের ঘরে ঢুকেছিলেন। স্বাতী ভেতর থেকে তালাবন্ধ করে শোয়। তবে রওশন আরার ঘরে ঢোকায় কোনো সমস্যা হয় না। তাঁর কাছে একটা লুকানো চাবি আছে। তিনি প্রায় রোজই গভীর রাতে তালা খুলে একবার ঢোকেন। ঘুমন্ত মেয়েকে দেখে চলে আসেন। স্বাতীর পাঁচ বছর বয়স থেকেই তিনি এই কাজটা করে আসছেন। পাঁচ বছর বয়সে মেয়ে প্রথম আলাদা ঘরে ঘুমুতে গেল। তখন দরজা খোলা থাকত। যখন-তখন ঘরে ঢোকা যেত। তারপর স্বাতী ঘরে চাবি দিতে শিখল। স্বাতী চোখ বড় বড় করে বলল, খবরদার মা, আর আমাকে বিরক্ত করবে না। যখন তখন আমার ঘরে আসবে না। আমার ভালো লাগে না।
রাতে ঘর বন্ধ করে ঘুমুতে ভয় লাগবে না তো বাবু?
খবরদার, আমাকে বাবু ডাকবে না।
ভয় লাগবে না তো ময়না সোনা?
ময়না সোনাও ডাকবে না।
কী ডাকব তাহলে? যা
নাম তা-ই ডাকবে। স্বাতী! স্বাতী নক্ষত্র!
রওশন আরা বললেন, আচ্ছা এখন থেকে শুধু নাম ধরেই ডাকব। এখন তুই বলতো মা, দরজা তালাবন্ধ করে ঘুমুতে ভয় লাগবে না?
লাগবে, তবু আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমুব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
স্বাতী দরজা ভেতর থেকে লক করেই ঘুমোয়। তিনি দরজা খুলে ভেতরে ঢোকেন। কাল রাতেও ঢুকেছেন। মেয়ে তখন গভীর ঘুমে। গায়ে দেবার চাদরটা খাটের নিচে। ঠাণ্ডায় সে কুঁকড়ে আছে অথচ মাথার উপরের ফ্যান ফুল স্পিডে ঘুরছে। তিনি একবার ভাবলেন, ফ্যান বন্ধ করে দেবেন। সেটা করা ঠিক হবে না, মেয়ে বুঝে ফেলবে কেউ একজন রাতে তার ঘরে ঢুকেছিল। তিনি ফ্যানের স্পিডটা কমিয়ে দিলেন। ফ্যানের কাঁটা পাঁচ থেকে দুই-এ নামিয়ে আনলেন। চাদরটা খাটের নিচ থেকে তুলে পায়ের কাছে রেখে দিলেন। তাঁর খুব ইচ্ছা করছিল ঘুমন্ত মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু দেন। ভাগ্য ভালো এই ভুল করেন নি। এই বয়সের মেয়েরা ঘুমুলেও তাদের শরীর জেগে তাকে। সামান্য স্পর্শেও এরা কেঁপে ওঠে। ধড়মড় করে উঠে বসে। ভীতগলায় চেঁচিয়ে বলে–কে? কে?
রওশন আরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, ওর সমস্যাটা কী?
নাজমুল সাহেব চায়ের টেবিলের পাশে ফুলদানি রাখতে রাখতে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন। রওশন আরা বললেন, তোমাকে চা দিয়ে দেব?
না থাক। দেখি ও যদি ওঠে।
তোমাকে এ-রকম চিন্তিত লাগছে কেন?
নাজমুল সাহেব নিচু গলায় বললেন, মনে হচ্ছে স্বাতী কাঁদছে। চাদরে মুখ ঢেকে কাঁদছে।
সে-কি!
নাও হতে পারে। আমার মনে হলো ওর গলার স্বরটা চাপা চাপা। তুমি গিয়ে দেখবে?
রওশন আরার যেতে ইচ্ছা করছে না। স্বামীর সঙ্গে অনকদিন থেকে একটা ব্যাপার ঠিক করা আছে। বার্থ ডে উইশ একেক বছর একেকজন করবে। প্রতিবারই নতুন কিছু করা হবে যেন মেয়ে চমকে ওঠে। গত বছর তিনি এই দিনে তোর ছটা দশ মিনিটে বলেছেন–শুভ জন্মদিন মা। জন্মদিনের উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন চল্লিশ ক্যারেটের গোল্ডেন টোপাজ। হাঁসের ডিমের মতো পাথর। ধবধবে সাদা চিনামাটির প্লেটে পাথরটা সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল এক খণ্ড সূর্য যেন সাদা প্লেটে ঝকমক করছে। স্বাতী আনন্দে আত্মহারা হয়ে চেঁচিয়েছে–এটা কী মা? এটা কী?