পুলিশকে ভয় পেলে তুই চলে যা। তোকে ধরে রেখেছি নাকি?
মুনির ইতস্তত করে বলল, হেড স্যার দেখলে খুব রাগ করবেন। তাছাড়া বাসায় আজ বড় খালামণির আসার কথা। বড় খালামণি আমাকে না দেখলে খুব রাগ করেন।
সাজ্জাদ বলল, তোর আসলে ভয় লাগছে। ভীতুর ডিম কোথাকার!
মুনির মুখ কালো করে ফেলল। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকল না। গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। মুনিরের সাথে টুনুও চলে গেল। তার নাকি পেট ব্যথা করছে। সাজ্জাদ বলল, বল্টু, তুইও যাবি নাকি?
নাহ।
কী করবি তাহলে? মিছিলের সাথে যাবি?
হুঁ। কিন্তু কিছু হয় যদি?
দূর, কী হবে?
ভয়াল-ছয়ের দুই সদস্য মিছিলে ঢুকে পড়ল। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা। গর্জনে চারদিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। একেকটা ঘামে ভেজা মুখ কী ভয়ঙ্কর রাগী। মিছিল যতই এগোচ্ছে মানুষের সংখ্যা ততই বাড়ছে। যেদিকে তাকানো যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। মিছিল কোনদিকে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
সাজ্জাদ আর বল্টু হাত ধরাধরি করে হাঁটছিল। হঠাৎ কে একজন পেছন থেকে বল্টুর শার্টের কলার চেপে ধরল। বল্টু ঘাড় ফিরিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। জামিল স্যার! অঙ্ক করান, দারুণ রাগী। স্যারের এক হাতে একটা লাল নিশান।
তোরা এখানে কী করছিস? যা, এক্ষুনি বাড়ি যা। এটা হাওয়া খাওয়ার জায়গা। আর কে কে আছে তোদের সাথে?
আর কেউ নেই, স্যার।
ঠিক করে বল।
না স্যার, আমরা দুজনই।
এক্ষুনি বাড়ি যা, খুব গণ্ডগোল হবে। ওই গলি দিয়ে বেরিয়ে পড়। এক্ষুনি। এক্ষুনি। খুব গণ্ডগোল হবে। দৌড়া। দৌড়া।
স্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই কোথাও কিছু একটা হলো। দারুণ ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল চারদিকে। ঢেউয়ের মতো মানুষের স্রোত আসতে লাগল। দুম দুম শব্দ হলো সামনে। গুলির শব্দ না টিয়ার গ্যাস? কয়েকজন প্রাণপণে চিৎকার করছে, আগুন আগুন! কোনোদিকে নড়ার রাস্তা নেই তবু এর মধ্যেই সাজ্জাদ প্রাণপণে ছুটছে। বল্টু তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। কালো কোট গায়ে দেওয়া একটা লোক বলল, এই খোকারা, মাটিতে শুয়ে পড়ো। দেখছ কী? গুলি হচ্ছে। ওরা কী করছে নিজেরা বুঝতে পারছে না। একজন বুড়ো মানুষ বললেন, কোনো ভোলা বাড়ি দেখে ঢুকে পড়ো। কোনো বাড়ির দরজা খোলা নেই। সাজ্জাদের মনে হলো সে আর দৌড়াতে পারছে না। ডান পায়ের নখ উঠে গেছে বা কিছু হয়েছে। এবার পেছন থেকে দ্রিম দ্রিম শব্দ আসছে।
একতলা একটি বাড়ির গেটে বুড়ো মানুষ একজন কে যেন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হাত বাড়িয়ে ওদের ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললেন।
সেদিন ছিল পহেলা মার্চ। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেছে সকাল এগারোটায়। বারোটা নাগাদ বাঙালিরা বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। সেই জনসমুদ্র দেখে স্তজিত সরকার দুপুর একটায় ঘোষণা করল, বিকেল পাঁচটা থেকে কার্ফু। কেউ ঘর থেকে বেরুবে না। সেই ঘোষণা বাতিল করে নতুন ঘোষণা দেওয়া হলো, কার্ফু বেলা তিনটা থেকে। যে যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। রাস্তায় দেখামাত্র তাদের গুলি করা হবে।
সাজ্জাদ এবং বল্টু আটকা পড়ে গেল একটা অচেনা বাড়িতে।
খোকনের ছোটচাচা আমিন সাহেব
খোকনের ছোটচাচা আমিন সাহেব ঢাকা এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছলেন বিকেল তিনটায়। চারদিক কেমন থমথম করছে। প্রচুর পুলিশ। এয়ারপোর্ট থেকে কেউ বেরুতে পারছে না।
আমিন সাহেবকে নেওয়ার জন্যে কেউ আসেনি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। কাস্টমসের একজন অফিসার বললেন, শহরে কার্ফু জারি হয়েছে। তবে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আপনাদের পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।
আমিন সাহেব দুঘন্টা অপেক্ষা করলেন। কোনো ব্যবস্থা হলো না। খোকনের ছোটচাচি রাহেলা খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। কারণ প্রিসিলার হঠাৎ শরীর খারাপ করেছে। দুবার বমি হয়েছে। জ্বর আসছে মনে হয়। ওকে ডাক্তার দেখানো উচিত। রাহেলা বললেন, এখন আমরা কী করব? সারা রাত এয়ারপোর্টে বসে থাকব নাকি?
অন্যরা যদি বসে থাকে আমরাও থাকব।
এ আবার কী ধরনের কথা? লোকজনদের সঙ্গে কথাটথা বলে দেখো কিছু করা যায় কি না।
আমিন সাহেব দুএক জায়গায় টেলিফোন করতে চেষ্টা করলেন। কোনো লাভ হলো না। লাইন নষ্ট বা কিছু একটা হয়েছে।
এয়ারপোর্টে বেশ কিছু লোক আটকা পড়েছে। একটি আমেরিকান ফ্যামিলিকে দেখা গেল খুব চিন্তিত। ভদ্রলোকের নাম পিটার কল। তিনি যেচে এসে আমিন সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন, তোমাদের শহরের অবস্থা তো ভয়াবহ মনে হচ্ছে।
হুঁ।
আন্দোলন হচ্ছে শুনেছিলাম, এতটা বুঝতে পারিনি।
নরওয়ে থেকে এক ভদ্রমহিলা এসেছেন, তিনি শহরে ঢুকতে চান না। পর ফ্লাইটে নরওয়ে চলে যেতে চান। ইংল্যান্ডের দুটি পরিবার আছে। ওদের সঙ্গে তিনটি ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েগুলি সমস্ত এয়ারপোর্ট জুড়ে ছোটাছুটি করছে। বাচ্চাগুলির মাকেও মনে হলো বেশ হাসিখুশি। খুট খুট করে ছবি তুলছে।
আমিন সাহেব ফিরে এসে দেখলেন প্রিসিলা আবার বমি করছে। তার গায়ে বেশ জ্বর।
কিরে প্রিসিলা, খারাপ লাগছে?
নো, আই অ্যাম জাস্ট ফাইন।
রাহেলা বললেন, কিছু ব্যবস্থা করতে পারলে না?
না। অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় মশাল মিছিল বের করছে। কেউ কার্টু মানছে না। গুলিটুলিও হচ্ছে বোধহয়, শব্দ শুনলাম।