এক জায়গায় এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তারা পাচিলে উঠে পা ঝুলিয়ে বসল। পাঁচিলে ওঠা নিষেধ। হেড স্যার খুব রাগ করেন। কিন্তু আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ। হেড স্যারের এদিকে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। যতক্ষণ ইচ্ছা পা ঝুলিয়ে বসে থাকা যাবে। বল্টু হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, মুনির আসছে। তিনজনেই তাকাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে। মুনির হনহন করে আসছে। তার হাতে কী একটা বই। গল্পের বই নিশ্চয়ই। ওদের দেখতে পেয়েই সে বই শার্টের নিচে লুকিয়ে ফেলল। মুনিরের সঙ্গে ওদের তেমন ভাব নেই। যে ছেলে প্রতি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয় তার সঙ্গে কারও ভাব থাকে না। ক্লাস টিচার সোলায়মান স্যারের ধারণা, মুনিরের মতো ভালো ছাত্র এই স্কুলে এর আগে আর ভর্তি হয়নি। পরে হবে না। গত বত্সর স্কুল ম্যাগাজিনে তার একটা ইংরেজি গল্প ছাপা হয়েছে। গল্পের নাম–দি বেগার বয়। হেড স্যার সেই গল্প আবার স্কুল অ্যাসেম্বলীতে পড়ে শুনিয়েছেন এবং বলেছেন, ক্লাস সেভেনের ছেলের ইংরেজি দেখলে? বিএ এমএ পাসরাও এমন লিখতে পারবে না। এর গল্পের মরালটা লক্ষ করবে–যে ছেলে ভিক্ষা করে তার মধ্যেও মনুষ্যত্ব আছে।
মুনির স্কুল গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। সন্দেহভরা গলায় বলল, অ্যাই, তোরা কী করছিস?
কিছু অছি না।
ওয়ালের উপর বসে আছিস কেন? হেড স্যার নিষেধ করেছেন না?
আমরা কারও নিষেধ মানি না।
ও, তোরা তো আবার ভয়াল-ছয়।
ভয়াল-ছয়টা মুনির এমনভাবে বলল যেন খুব একটা হাস্যকর ব্যাপার। সাজ্জাদ চুপ করে বুইল। দলের কথাটা এরকম জানাজানি হলে কী করে কে জানে। মুনির নিষেধ না মানার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই।
না থাকলে নাই। আমরা নিষেধ মানি না।
কোনো নিষেধ মানি না?
না। তোর শার্টের নিচে এটা কী বই?
রাতের আতঙ্ক। এটা আমি কাউকে দিতে পারব না। এখনো পড়া হয়নি।
তোর বই আমরা চাই না।
তারা চুপ করে গেল। মুনির চলে যাচ্ছে না। দাঁড়িয়েই আছে। বল্টু বলল, তুই চলে যা। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
তুই কী করছিস?
আমি যা-ই করি তাতে তোর কী?
মুনির ইতস্তত করে বলল, আমাকে দলে নিলে এই বইটা পড়তে দেব।
সে শার্টের ভেতর থেকে বই বের করল। মোটা একটা বই। মলাটে মুখখাশপরা একটা মানুষের ছবি। তার হাতে পিস্তল। অন্য হাতে লম্বা একটি বর্শা।
কি, নিবি আমাকে দলে?
ভালো ছাত্রদের আমরা দলে নিই না।
কেন? ভালো ছাত্ররা কী দোষ করল?
ভালো ছাত্ররা পড়াশোনা করবে। আমরা পড়াশোনা করব না।
কী করবি তাহলে?
দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াব।
আমিও ঘুরব তোদের সাথে।
মুনিরকেও দেখা গেল দেয়ালের ওপর উঠে বসেছে। ভয় পাওয়া গলায় বলল, পড়ে যাব না তো?
কেউ উত্তর দিল না।
আমাকে দলে নিয়েছিস?
ভেবে দেখি। দলের অন্যরা যদি রাজি হয়।
অন্যরা কখন আসবে?
আসবে এক্ষুনি।
কিন্তু দলের অন্যদের আসার আগেই স্কুলের দপ্তরি কালিপদ এসে বলল, হেড স্যার আপনাদের ডাকে। টুনুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সাজ্জাদ বিড়বিড় করে বলল, হেড স্যার কোত্থেকে এলেন? কালিপদ তার জবাব দিল না। হাত ইশারা করে দেখাল। হেড স্যার হোস্টেলের বারান্দায় লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখের ভাব অস্বাভাবিক গম্ভীর।
হেড স্যার প্রথম কিছু সময় কোনো কথাই বললেন না। তারা যে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও যেন চোখে পড়েনি। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘ গর্জন করলেন।
ওয়ালের উপর বসে ছিলি কেন?
কোনো জবাব নেই।
তোর হাতে ওটা কী বই?
রাতের আতঙ্ক।
এসব আজেবাজে বই পড়তে নিষেধ করেছি, মনে নাই?
সবাই চুপচাপ।
তোদের বলি নাই–এখন চারদিকে ঝামেলা হচ্ছে এখন ঘরে বসে থাকবি? পাঠ্যবই পড়বি। ট্রান্সলেশন করবি।
জি স্যার, বলেছেন।
দু বছর পর এসএসসি পরীক্ষা। খেয়াল আছে? শাহজাহান বল তো, রাইনোসেরাস মানে কী?
গণ্ডার স্যার।
রাইনোসেরাস বানান কর।
শাহজাহান টেনে টেনে বলল, আর ওয়াই…। বলেই থেমে গেল। হেড স্যার আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। মুনির ফিসফিস করে বলল, স্যার আমি বলব?
না, তোমার বলতে হবে না। যাও, এখন ঘরে যাও। খবরদার কোনো মিছিলে টিছিলে যাবে না।
জি আচ্ছ, স্যার।
আর এই বইটা রেখে যাও আমার কাছে। ম্যাট্রিক পাস করার আগে কোনো আউট বই পড়বে না। যেসব বই পড়ে কিছু শেখা যায় না সেসব বই পড়ার কী মানে? বলো কোনো মানে আছে?
নাই, স্যার।
যাও, বাড়ি যাও। আর এই তুমি, ঘাস চিবাচ্ছ কেন? ঘাস খায় ছাগলে। তুমি কি ছাগল? বলো, তুমি ছাগল?
টুনু মুখ কালো করে বলল, জি-না স্যার।
ঘাস-লতাপাতা এসব যেন আর খেতে না দেখি। যাও, বাড়ি যাও।
বড় রাস্তার মোড়ে এসে টুনু বলল, সে বাড়ি চলে যাবে। সাজ্জাদ বলল, যেতে চাইলে যা, তোকে আমরা বেঁধে রেখেছি?
এটা রাগের কথা। এরপর যাওয়া যায় না। এই সময় একটা বেশ বড়সড় মিছিল আসতে দেখা গেল। সমুদ্রগর্জনের মতো গর্জন, জেগেছে জেগেছে বীর জনতা জেগেছে, জাগো জাগো জাগো, বীর জনতা জাগো। সাজ্জাদ বলল, যাবি নাকি মিছিলে?
কেউ কিছু বলল না। শুধু মুনির বলল, না, স্যার নিষেধ করেছেন।
ওরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। মিছিলটাও প্রকাণ্ড। শেষই হতে চায় না। পেছনে চার-পাঁচটা পুলিশের ট্রাক। দেখলেই কেমন ভয় লাগে। মুনির ফিসফিস করে বলল, খুব গণ্ডগোল হবে। চল বাড়ি যাই।
তোর ভয় লাগে, তুই যা।
কত পুলিশ, দেখেছিস?