খোকন ঠিক করে বললো তো তোমার শরীর খারাপ করেনি তো?
জি-না।
দেখি এদিকে এসো, জ্বর আছে কি না দেখি।
তিনি খোকনের কপালে হাত রাখলেন।
না, জ্বর নেই তো।
রকিব সাহেব আবার অবাক হলেন। যেন জ্বর না থাকাটাও অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার।
কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলে, কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলে নাকি?
হ্যাঁ।
আমাকে বলতে চাও? বলতে চাইলে বলতে পারো।
খোকন ইতস্তত করতে লাগল। বাবা বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। মাঝে মাঝে খোকনের প্রতি তার আগ্রহ খুব বেড়ে যায়। খুব খোঁজখবর করেন। তারপর আবার আগ্রহ কমে যায়। বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিছুই আর মনে থাকে না।
আমরা ছয়জন বন্ধু মিলে একটা দল করেছি। দলের নাম ভয়াল-ছয়।
বলো কী! খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। দলের কাজ কী?
আমার ভূ-পর্যটন করব।
ভূ-পর্যটন করবে?
হ্যাঁ। প্রথমে যাব আফ্রিকা।
বাহ, বেশ মজার তো।
বাবা এবার আর অবাক হলেন না। হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ছোটবেলায় আমিও একটা দল করেছিলাম। আমাদের দলের কাজ ছিল গুপ্তধন খুঁজে বের করা। কোনো গুপ্তধন আমরা খুঁজে পাইনি। তখন আমার বয়স ছিল বারো কি তেরো। তোমার এখন কত বয়স?
তেরো বছর তিন মাস।
এই বয়সটাই হচ্ছে দল করবার বয়স।
বাবা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।
কবে যাচ্ছ আফ্রিকায়?
এখনো ঠিক হয়নি।
তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলা দরকার। আমরা সবসময় শুধু পরিকল্পনা করি। কাজ আর করা হয় না। তোমরা যদি একদিন সত্যি সত্যি হাঁটতে শুরু করো, তাহলে ভালোই হবে। মাইল দশেক যেতে পারলেও অনেক কিছু শিখবে।
বাবা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। খোকন বুঝতে পারল না এখন তার কী করা উচিত। চলে যাওয়া উচিত না দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। কারণ বাবার অন্যমনস্কতা খুব বিখ্যাত। একবার শুরু হলে দীর্ঘ সময় থাকে। তখন কাউকে চিনতে পারেন না।
খোকন।
জি।
ছুটির দিনে তুমি তোমার দলের সঙ্গে না থেকে ঘরে বসে আছ কেন?
বড়চাচা বলেছেন আজ কোথাও বেরুতে পারব না।
ও আচ্ছ। কারণটা কী?
খোকন কারণ বলল। রকিব সাহেব বললেন, শাস্তিটা একটু মনে হয় বেশি হয়ে গেছে। তোমার কী মনে হয়?
খোকন কিছু বলল না।
তোমার বড়চাচা হয়তো ভেবেছেন তুমি মিছিল-টিছিলে গিয়েছ, সেজন্যেই এমন শাস্তি। তুমি গিয়েছিলে নাকি?
না।
কখনো যাওনি?
খোকন চুপ করে রইল।
কয়েকবার গিয়েছ, তাই না?
হ্যাঁ।
আমার কী মনে হয় জানো? আমার মনে হয়, মিছিল করবে যুবকরা। মিছিল হচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। এ কাজটি যুবকদের জন্যে। শিশুরা শিখবে, যুবকরা কাজ করবে, বৃদ্ধরা ভাববে। ঠিক না?
হ্যাঁ।
রকিব সাহেব হঠাৎ করে খানিকটা গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমার কি ধারণা শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হবেন?
আমি জানি না। এ নিয়ে কখনো ভেবেছ?
না।
আমি অবশ্যি অনেক ভেবেছি। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করা ছাড়া ওদের উপায় নেই। ইলেকশনে জিতেছেন। কিন্তু ওরা করতে চাহে না। ওদের অজুহাত বের করতে হবে। কী অজুহাত দেবে সেটাও একটা সমস্যা। সমস্যা নয়?
হ্যাঁ।
এদিকে ভুট্টো সাহেব বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আমার দল সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। তার মানে কী বলতে পারো?
না।
ভুট্টো সাহেবই পাকিস্তানকে দুটি অংশ হিসেবে ভাবছেন। অথচ তারা দোষ আমাদের। ভাবখানা এরকম যেন আমরাই পকিস্তানকে দুভাগে ভাগ করতে চাচ্ছি।
আমরা চাচ্ছি না?
ওরা যা শুরু করেছে তাতে চাওয়াই উচিত। আমি অন্তত চাই। তবে যারা একসময় পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছেন, দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন, তারা নিশ্চয়ই চান না। যেমন তোমার বড়চাচা।
বড়চাচা চান না?
মনে হয় না। তবে আমার ভুলও হতে পারে।
শেষপর্যন্ত কী হবে? পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাবে?
নির্ভর করছে ওদের ওপর। ওরা যদি আমাদের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করে তাহলে হয়তোবা ওদের সঙ্গে থাকা যাবে। কিন্তু ওরা আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। পরিস্থিতি ভালো না।
বাবা কথা শেষ না করেই চটি ফটফট করে তার ঘরে ঢুকে গেলেন। খোকন চলে গেল ছাদে। এ বাড়ির ছাদটা প্রকাও। রোজ বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলে অনজু আর বিলু। চুন দিয়ে ঘর আঁকা আছে।
খোকন বেশ খানিকক্ষণ একা একা ঘুরে বেড়াল। ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছিল না। আবার নিচে যেতেও ইচ্ছা করছিল না। একসময় রতনের মা এসে বলল, এখন নাশতা দেই?
বললাম তো কিছু খাব না।
এক গ্লাস দুধ আইন্যা দিমু।
না।
আপনেরে আম্মা ডাকে।
একটু আগেই গেলাম। আবার?
হ্যাঁ। আসেন আমার সাথে।
খোকন দেখল তার মা হাঁপাচ্ছেন। অসুখ বোধহয় খুব বেড়েছে। খোকন বলল, মা ডেকেছ?
হ্যাঁ, তুই নাকি কিছু খাস নাই? কেনরে ব্যাটা, কারও উপর রাগ করেছিস?
না।
আমি তো কোনো খোঁজখবর করতে পারি না। কী খাস না-খাস কে জানে!
আমি ঠিকই খাই।
মা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, রতনের মা, যাও তো খোকনের খাবার নিয়ে এসো। আমার সামনে বসে সে খাবে। খোকনের একবার ইচ্ছা হলো বলে, ছুটির দিনে খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করা যাবে না। বডচাচার নিষেধ আছে। কিন্তু সে কিছু বলল না। মাকে কষ্ট দিতে তার কখনো ইচ্ছা করে না। মা এত ভালো।
ভয়াল-ছয় বাহিনীর তিনজন সদস্য
ভয়াল-ছয় বাহিনীর তিনজন সদস্যকে স্কুল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তিনজনই অত্যন্ত বিমর্ষ। টুনু একটা ঘাসের ডাটা চিবুচ্ছে। সাজ্জাদ রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে। দলের বাকি সদস্যদেরও এসে পড়ার কথা। কেউ আসছে না। সময় সকাল দশটা। রোদ উঠেছে কড়া। বেশ গরম লাগছে। টুনু বলল, চল ছায়াতে দাড়াই। কেউ জবাব দিল না। ওইদিন টুন কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না।