সাজ্জাদ কিছু বলল না। বড়চাচা হঠাৎ করে কেন রেগে যাচ্ছেন সে বুঝতে পারছে না।
আওয়ামী লীগ ইলেকশনে জিতেছে, ভালো কথা। কিন্তু এমন করছে যেন তারা যা বলবে তাই। আরে বাবা, পাকিস্তানের কথাও তো শুনতে হবে। হবে কি না বলো?
সাজ্জাদ না বুঝেই মাথা নাড়ল।
শেখ সাহেবের যে পরিকল্পনা তাতে তো দেশটাই ছারখার হবে। পাকিস্তান আনার জন্যে আমরা কম কষ্ট করেছি। এখন পাকিস্তানের কথা বলে না, সবাই শুধু বাঙালি বাঙালি করে। বাঙালি ছাড়াও তো লোক আছে। পাঞ্জাবি আছে, সিন্ধী আছে, এরা মানুষ না। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকা যায় না।
জি যায়।
বড়চাচা গলা উচিয়ে বললেন, মিছিল-টিছিলে কখনো যাবে না। এখন পড়াশোনায় সময়। পড়াশোনা করবে। ব্যস। কথায় কথায় মিছিল–এসব কী? যাও বাড়ি যাও।
ছুটির দিনে খোকন
ছুটির দিনে খোকন সাধারণত খুব ভোরে ওঠে। বই নিয়ে পড়তে হবে না এই আনন্দেই ঘুম ভেঙে যায় সকাল সকাল। এখন সবদিনই ছুটি। অনেকদিন ধরে স্কুল হচ্ছে না। তবু এ বাড়ির নিয়মে ছুটি মাত্র একদিন–শুক্রবার। সেদিন ঘুম থেকে ওঠার জন্যে কেউ ডাকডাকি করবে না। কেউ যদি সারা দিন ঘুমাতে চায় তাহলে তাও পারবে। ছোটরা বাড়ির ভেতর চিৎকার চেঁচামেচি করলেও তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। টিভির সামনে রাত এগারোটা পর্যন্ত বসে থাকলেও কেউ বলবে না-যাও, ঘুমুতে যাও। সেদিন হচ্ছে স্বাধীনতার দিন।
আজ শুক্রবার। খোকন জেগে উঠেছে খুব ভোরে। তার ইচ্ছে হলো কিছুক্ষণ চেঁচিয়ে কাঁদতে। এরকম সুন্দর একটি ঝকঝকে দিনে তাকে ঘরে বসে থাকতে হবে। তাছাড়া আজ দুপুরে স্কুলের বারান্দায় ভয়াল-ছয়ের একটি গোপন জরুরি মিটিং বসবে। সে মিটিং-এ সবাই থাকবে, শুধু সে থাকবে না। সবাই হয়তো ভাববে সে আর ভয়াল ছয়ে নেই। তাকে বাদ দিয়েই আজ নিশ্চয়ই সব ঠিকঠাক হবে। খোকন হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রতনের মা এসে একবার জিজ্ঞেস করল–নাশতা ঘরে দিয়ে যাবে কি না। খোকন বলল, সে আজ নাশতা খাবে না, তার খিদে নেই। রতনের মা দ্বিতীয়বার কিছু বলল না। শুক্রবার খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করা নিষিদ্ধ। কেউ খেতে চাইলে খাবে না। রতনের মা দুমিনিট পরেই আবার এসে হাজির।
দাদাভাই, আপনেরে ডাকে।
কে ডাকে?
আপনের আম্মা।
খোকনের মার শরীর মনে হয় আজ অন্যদিনের চেয়েও খারাপ। মাথার নিচে তিন চারটা বালিশ দিয়ে তাকে শোয়ানো হয়েছে। মুখ রক্তশূন্য। ঘরের বড় বড় জানালায় ভারী পর্দা ঝুলছে। চারদিক অন্ধকার। খোকন ঘরে ঢুকতেই তিনি নিচুগলায় বললেন, কাল বিকেলে তোকে খুঁজছিলাম, কোথায় ছিলি?
মায়ের সামনে খোকন মিথ্যা বলতে পারে না। সে মৃদুস্বরে বলল, বাইরে ছিলাম।
মিছিল-টিছিলে যাস নাই তো?
না।
ঝামেলার মধ্যে যাবি না, কেমন?
আচ্ছা।
বস্ এখানে। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই তো আমার ঘরে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিস।
খোকন বসল। খোকনের মা বললেন, একটা কমলা খাবি?
না।
না কেন, খা একটা।
তিনি একটি কমলা বের করে দিলেন।
আমার কাছে দে, আমি ছিলে দিচ্ছি।
আমি ছিলতে পারব।
দে আমার কাছে।
খোকনের মা কমলা ছিলতে লাগলেন। কিন্তু দেখে মনে হলো এটুকু কাজ করতেই তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তিনি টেনে টেনে বললেন, মিস গ্রিফিন বলছিল গণ্ডগোল নাকি প্রায় মিটমাটের দিকে। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নাকি শেখ মুজিবের মিটমাট হয়ে গেছে। এখন নাকি শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবে।
খোকন কিছু বলল না।
মিটমাট হয়ে গেলেই হয়। মনে একটা শান্তি পাওয়া যায়। তাই না খোকন।
হ্যাঁ।
কিন্তু তোর বাবা বলছিল, এত সহজে নাকি কিছু হবে না। পাকিস্তানিরা নাকি চায় না শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হয়। আমি এখন কার কথা বিশ্বাস করি?
খোকন উঠে দাঁড়াল।
মা এখন যাই।
বোস না আরেকটু, বোস।
পরে আসব।
আচ্ছা আসিস। মিছিল-টিছিলে যাস না কিন্তু, লক্ষ্মী বাবা।
বললাম তো আমি যাই না।
ওইসব বাচ্চাছেলেদের জন্যে না।
খোকন নিজের ঘরে এসে মুণ্ডুহীন লাশ পড়তে বসল। মঞ্জুর কাছ থেকে বহু সাধ্য সাধনা করে আনা হয়েছে। কিন্তু পড়তে ভালো লাগছে না। খোকন বই বন্ধ করে জানালার পাশে বসে রইল। জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে টুনুকে। তার জন্যেই ঘুর ঘুর ব্ৰছে বোধহয়। যারা সাধারণ গরিব ঘরের ছেলে তাদের মতো সুখী বোধহয় আর কেউ নেই। কেউ তাদের আটকে রাখে না। যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। এই যে সাজ্জাদ, মিছিল দেখলেই ঢুকে পড়ে। কেউ তাকে কিছু বলে না। একদিন একা একা গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে এল।
খোকন জানালা বন্ধ করে দিল। বাইরে তাকিয়ে থাকতেও খারাপ লাগছে। দোতলার সিড়িতে অনজু আর বিলু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। খোকন কড়াগলায় ধমক দিল, গোলমাল করিস না। ওরা গোলমাল করতেই লাগল। করবে জানা কথা। আজ ছুটির দিন। ওরা কোনো কথা শুনবে না। খোকন ভাবল, ছাদে গিয়ে বসে থাকবে। চুপচাপ।
ছাদে যাবার পথে বাবার সঙ্গে দেখা। বাবা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার কি অসুখ করেছে?
জি-না।
কাল অনেক রাত পর্যন্ত তোমার ঘরে বাতি জ্বলছিল, কী করছিলে?
কিছু করছিলাম না।
জেগে ছিলে নাকি?
জি।
জেগে ছিলে অথচ কিছুই করছিলে না?
বাবা খুবই অবাক হলেন। বোকনের বাবা রকিব সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন টিচার। ইতিহাস পড়ান। তিনি খুব সহজে অবাক হতে পারেন। তাঁর বেশ কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। যেমন, প্রায়ই খোকনের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে কথা বলেন। সেসময় তাকে তুমি তুমি করে বলেন। অন্যসময় তুই করে।