জি রাখব।
লিখবার আগে ছোটদের এনসাইক্লোপিডিয়াটাও দেখে নেবে। আমি হয়তো অনেক পয়েন্ট মিস করেছি।
আমি দেখে তারপর লিখব।
গুড। আর শোনো, সন্ধ্যাবেলা তোমার মা তোমার খোঁজ করছিলেন। সারা বিকাল তুমি তার কাছে যাওনি। চারদিকে ঝামেলা টামেলা হচ্ছে, সে খুব চিন্তিত থাকে। যাও, দেখা করে আসো।
.
মা থাকেন দোতলায় সবচেয়ে শেষ ঘরটায়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। হার্টের খুব খারাপ ধরনের একটা অসুখ, যাতে একটুও নড়াচাড়া করা যায় না। রাতেরবেলা একজন অ্যাংলো নার্স মিস গ্রিফিন এসে মার সঙ্গে থাকে। সে ছেলেদের মতো সিগারেট খায়। বাচ্চারা কেউ শব্দ করে সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই প্রচণ্ড ধমক দেয়।
মিস গ্রিফিন মার ঘরের সামনের বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিল। খোকনকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বলল, কী চাও তুমি?
মার কাছে যাব।
এখন না। এখন ঘুমাচ্ছে। সকালে আসবে। গো অ্যাওয়ে।
খোকন নিচে নেমে এসে দেখল টেবিলে ভাত দেওয়া হয়েছে। ফার্স্ট ব্যাচ খেতে বসবে। ফার্স্ট ব্যাচ হচ্ছে বাচ্চাদের, যাদের বয়স পনেরোর নিচে, তাদের। এদের সঙ্গে বসে খেতে খোকনের লজ্জা লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই, বড়চাচার নিয়ম। কবির ভাই গত নভেম্বরে পনেরোতে পড়েছেন। কাজেই তিনি এখন গম্ভীর মুখে সেকেন্ড ব্যাচ বড়দের সঙ্গে খেতে বসেন। ফার্স্ট ব্যাচ খেতে বসলেই এক ফাঁকে এসে বলেন, আহ বড় গণ্ডগোল হচ্ছে। খাওয়ার সময় এত কথা কিসের? খোকনের গা জ্বলে যায়। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায় কী?
খেতে বসেই খোকন জানতে পারল কী জন্যে আজ বাড়িতে এমন খুশি খুশি ভাব। ছোটচাচারা আমেরিকা থেকে ঢাকা চলে আসছেন। বিদেশ আর ভালো লাগছে না। আনন্দে খোকন বিষম খেয়ে ফেলল। ছোটচাচা এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবেন, এরচেয়ে আনন্দের খবর আর কিছু হতে পারে নাকি?
ছোটচাচা ফুর্তি ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারেন না। সবসময় তার মাথায় মজার মজার সব ফন্দি আসে। খোকন যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে তখন তিনি একবার ঠিক করলেন, ঢাকা শহরের ভিক্ষুকদের গড় আয় কী তা নিয়ে একটা সমীক্ষা চালাবেন। সমীক্ষার বিষয় হচ্ছে একজন ভিক্ষুক দৈনিক কত আয় করে। তারপর একদিন সত্যি সত্যি নকল দাড়িগোঁফ লাগিয়ে ময়লা একটা লুঙ্গি পরে খালিগায়ে ভিক্ষা করতে বেরুলেন। দুপুর তিনটার মধ্যে আড়াই সের চাল, এক টাকা পয়ত্রিশ পয়সা এবং একটা ছেড়া হলুদ রঙের সোয়েটার পেয়ে গেলেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, পেশা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তি খুব খারাপ না। যে লোক এমন একটা কাণ্ড করে তাকে ভালো না বেসে পারা যায়?
খোকন খাওয়া শেষ করে যখন হাতমুখ ধুচ্ছে তখন বড়চাচা বেরুলেন তার ঘর থেকে। খোকনের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তস্বরে বললেন, সাতটা বাজার দশ মিনিট আগে আমি তোমাকে এ বাড়িতে দেখিনি, কোথায় ছিলে? খোকন বলতে চেষ্টা করল, বাথরুমে ছিলাম। বলতে পারল না। কথা গলা পর্যন্ত এসে আলজিবে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। বড়চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, চারদিকে হাঙ্গামা-হুজ্জত হচ্ছে। এর মধ্যে তুমি বাইরে। স্বাধীনতা বেশি পেয়ে যাচ্ছ। যাই হোক, তুমি কোথায় ছিলে কী করছিলে তা শুদ্ধ বাংলায় লিখে আজ রাত দশটার মধ্যে আমার কাছে জমা দেবে।
জি আচ্ছা।
কাল সারা দিন ঘর থেকে বেরুবে না। সারা দিন থাকবে দোতলায়। নিচে নামবে না।
জি আচ্ছা।
মিছিল-টিছিলে গিয়েছিলে নাকি?
জি-না।
আচ্ছা ঠিক আছে, যাও।
খোকন দোতলায় তার নিজের ঘরে এসে মুখ কালো করে বসে রইল। কী জন্যে আজ ফিরতে দেরি হয়েছে তা লেখাটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না। বিষয়টা গোপনীয়। কিন্তু বড়চাচার কাছে গোপন করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? নির্ঘাৎ ধরে ফেলবেন।
খোকন একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সত্যি কথাই লিখতে শুরু করল। লেখা হলো সাধু ভাষায়। আজ (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১) আমরা একটি গোপন দল করিয়াছি। দলটির নাম ভয়াল-ছয়। দলের সদস্য সংখ্যা ছয়। সদস্যরা কিছুদিনের মধ্যেই পায়ে হাঁটিয়া পৃথিবী ঘুরিতে বাহির হইবে। আমাদের প্রথম গন্তব্য আফ্রিকার গহীন অরণ্য। কঙ্গো নদীর পার্শ্ববতী অঞ্চল।
ভয়াল-ছয় বাহিনী
প্রায় দশটা বাজে।
ভয়াল-ছয় বাহিনীর দুজন সদস্যকে দেখা গেল খোকনদের বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। দুজন বেশ চিন্তিত। একজনের নাম শাহজাহান। সে বেশ বেঁটে। তার বন্ধুদের ধারণা, যতই দিন যাচ্ছে ততই সে বেঁটে হচ্ছে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় সে নাকি এতটা বেঁটে ছিল না। ক্লাসের ছেলেরা তাকে শাহজাহান ডাকে না, ডাকে বল্টু। বেটে ছেলেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সাধারণত খুব লম্বা হয়। কিন্তু শাহজাহানের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম আছে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদও সাইজে শাহজাহানের মতোই। সাজ্জাদ পড়াশোনা ও মারামারি দুটোতেই সমান দক্ষ বলে তার অন্য কোনো নাম নেই। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় টুনু তাকে দুয়েকবার মুরগি ডাকার চেষ্টা করেছে। সাজ্জাদ টিফিন টাইমে টুনুর নাকে গদাম করে একটা ঘুসি মেরে বলেছিল, আর মুরগি ডাকবি? টুন দুহাতে নাক চেপে বলল, না।
বল, কোনোদিন ডাকব না।
কোনোদিন ডাকব না।
টুনু মুরগি নাম দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেনি। উল্টো তাকেই সবাই চীনা-মুরগি ডাকতে শুরু করল। চীনা-মুরগিও ভয়াল-ছয় বাহিনীর একজন সদস্য। তারও খোকনদের বাসায় আসার কথা ছিল। আসতে পারেনি, কারণ তার ছোটভাই আজ সকালেই সাইকেলের নিচে পড়ে হাত ছিলে ফেলেছে। টুনুকে তার ভাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। সাড়ে নটার মধ্যে টুনুর চলে আসার কথা। কিন্তু আসছে না। এদিকে খোকনও বেরুচ্ছে না বাড়ি থেকে। সাজ্জাদ বলল, কী করবি পন্টু? গেট দিয়ে ঢুকবি খোকনদের বাড়ি।