হচ্ছে। এইটুকু লেখা হওয়া মাত্রই খুব কাছেই কোথাও ঝাকে ঝাকে গুলির শব্দ হতে লাগল। ক্যাট ক্যাট করতে লাগল মেশিনগান। দাদুমণি নীলুর দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভীতস্বরে বললেন, দরজা খোল নীল।
নীলু দরজা খুলল না। দাদুমণি দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বললেন, মেঝেতে শুয়ে পড় নীলু, মেঝেতে শুয়ে পড়।
নীলু তাও করল না। পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। গুলির শব্দ থেমে গেল। কিন্তু একজন পুরুষমানুষের চিৎকার শোনা যেতে লাগল। ভয়াবহ চিৎকার। নীলু দরজা খুলে বেরিয়ে এল। তার মুখ রক্তশূন্য। সে কাঁপা গলায় বলল, ওর কী হয়েছে দাদুমণি?
জানি তো না নীল।
কেউ কি দেখতে যাবে না ওর কী হয়েছে?
দাদুমণি সে-কথার জবাব দিতে পারলেন না। নীলু দ্বিতীয়বার বলল, কেউ কি যাবে না?
সাতাশ তারিখ চার ঘণ্টার জন্যে কার্ফু তোলা হলো। মানুষের ঢল নামল রাস্তায়। বেশিরভাগই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। করুণ অবস্থা। যানবাহন সেরকম নেই। সময়ও হাতে নেই। যে অল্প কয়েক ঘন্টা সময় পাওয়া গেছে তার মধ্যেই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। পথে পথে মানুষের মিছিল। কিন্তু এই মিছিলের চরিত্র
বড় রাস্তার সব কটি মোড়ে সৈন্যবাহিনী টহল দিচ্ছে। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তি ও উল্লাস। তাদের ধারণা যুদ্ধে তাদের জয় হয়েছে। তারা অলস ভঙ্গিতে নতুন ধরনের মিছিল দেখছে। এই মিছিলে আকাশফাটানো ধ্বনি নেই। এই মিছিলে কেউ পাশের মানুষটির সঙ্গেও কথা বলে না। শিশু কেঁদে উঠল মা বলেন, চুপ চুপ। শিশুরা কিছুই বোঝে না, তারা কাঁদে এবং হাসে। নিজের মনে কথা বলে। বয়স্ক মানুষেরা বলে, চুপ
যারা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেককেই কাঁদতে দেখা যায়। তাদের কী হয়েছে। প্রিয়জন পাশে নেই? যার রাতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল সে কি ফিরেনি? প্রশ্ন করার সময় নয় এখন। যে চার ঘন্টা সময় পাওয়া গেছে এর মধ্যেই শহর ছাড়তে হবে। সময় ফুরিয়ে আসছে। সবাই দ্রুত যেতে চেষ্টা করে। শিশুরা হাসে ও কাঁদে, কোনো কিছুই তাদের বিচলিত করে না।
মিলিটারিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জনস্রোত দেখে। তাদের চকচকে বন্দুকের নল রোদের আলোয় ঝকমক করে। তারা মাঝেমাঝে কথা বলে নিজেদের মধ্যে, মাঝে মাঝে হেসে ওঠে। নিশ্চয়ই কোনো আশা ও আনন্দের গল্প। মজার কোনো স্মৃতি নিয়ে তামাশা। ওদের উচ্চস্বরের হাসির শব্দে শুধু শিশুরাই অবাক হয়ে তাকায়। আর কেউ তাকায় না।
কার্ফু শুরু হয় চারটায়। রাস্তাঘাট আবার জনশূন্য হয়ে যায়। শহরের অবস্থা যারা দেখতে বেরিয়েছিল তারা ঘরে ফিরে অসম্ভব গম্ভীর হয়ে যায়। দাদুমণি ঘণ্টাখানেকের জন্যে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরেই শান্তস্বরে বললেন, শহর ছাড়তে হবে। কালই আমরা শহর ছাড়ব। তারপর আর কোনো কথা বলেন না। বিকাল চারটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি তার ঘরে একা একা বসে থাকেন।
খোকনদের বাড়ি খুব চুপচাপ
খোকনদের বাড়ি খুব চুপচাপ হয়ে গেছে।
অনজু আর বিলু এখন আর চেঁচিয়ে এক্কাদোক্কা খেলে না। বড়চাচা সারা দিন তার নিজের ঘরেই বসে থাকেন। কারও সঙ্গে বিশেষ কথাটথা বলেন না। খোকনও বেশিরভাগ সময় থাকে তার নিজের ঘরে। সময় শুথ হয়ে গিয়েছে। মা মারা গেছেন মাত্র তিন দিন আগে অথচ খোকনের কাছে মনে হয় বহু বৎসর কেটে গেছে। আজ সকালবেলা হঠাৎ কী মনে করে খোকন তার মায়ের ঘরে গেল। সবকিছু আগের মতো আছে। মার লাল রঙের চটি দুটি পর্যন্ত যত্ন করে তুলে রাখা।
খোকন।
খোকন দেখল, বাবা এসে দাঁড়িয়েছে, দরজার পাশে।
কী করছ খোকন?
কিছু করছি না।
এসো আমার ঘরে এসো। আমরা গল্প করি।
খোকন তার বাবার সঙ্গে চলে গেল। বাবাও যেন কেমন হয়ে গেছেন। হঠাৎ করে তার যেন অনেক বয়স বেড়ে গেছে।
খোকন, মার জন্যে খারাপ লাগছে?
হুঁ।
লাগাই উচিত।
বাবা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ব্যক্তিগত দুঃবই সবচেয়ে বড় দুঃখ। আমাদের কথাই ধরো, আমরা নিজেদের দুঃখে কাতর হয়ে আছি, ঠিক না?
হ্যাঁ।
কিন্তু দেশের কী অবস্থা হচ্ছে বুঝতে পারছ তো? খুব খারাপ অবস্থা। এবং যতই দিন যাবে ততই খারাপ হবে।
খোকন কিছু বলল না। নিচ থেকে এই সময় বড়চাচির কান্না শোনা গেল। বাবা চুপ করে গেলেন। কবীর ভাই এখনো ফিরে আসেননি। বড়চাচি দিনরাত সর্বক্ষণ তার জন্যে কাঁদেন। দিনেরবেলায় কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু রাতেরবেলা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাবা বললেন, একমাত্র মহাপুরুষদের কাছেই ব্যক্তিগত দুঃখের চেয়েও দেশের দুঃখ বড় হয়ে ওঠে। আমরা মহাপুরুষ না। আমাদের কাছে আমাদের কষ্টটাই বড় কষ্ট।
বড়চাচির কান্নার শব্দ ক্রমেই বাড়তে লাগল। বাবা চুপ করে বসে রইলেন। তারপর প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে বললেন, তোমার কি মনে হয় বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন?
আমি জানি না।
সে তো কেউ জানে না। কিন্তু তোমার কী মনে হয়?
আমার কিছু মনে-টনে হয় না।
এভাবে কথা বললে তো হবে না খোকন। এখন থেকে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। খুব খারাপ সময় আমাদের সামনে।
খোকন চুপ করে রইল। বাবা শান্তস্বরে বললেন, এখন ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হবে। সেই যুদ্ধ অনেকদিন পর্যন্ত হয়তো চলবে। এর মধ্যেই তোমরা বড় হবে। কী খোকন, চুপ করে আছ কেন, কিছু বলো।
কী বলব?