এক রাতে এ শহর মৃতের শহর হয়ে গেল। অসংখ্য বাবা তাদের ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে গেল না। অসংখ্য শিশু জানল না বড় হয়ে ওঠা কাকে বলে। বেঁচে থাকার মানে কী?
শহরের জনশূন্য পথে দৈত্যাকৃতি ট্রাক চলল। ধ্বংস ও মৃত্যু। স্বজনহারা মানুষদের কান্নার সঙ্গে ঠাঠা শব্দে গর্জাতে লাগল মেশিনগান। জেনারেল টিক্কা খান বাঙালির মরুদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। যেন এরা দ্বিতীয়বার আর পাকিস্তানিদের মুখের ওপর কথা বলার স্পর্ধা না পায়।
পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তানের জনদরদী ভুট্টো চলে গেল পাকিস্তানে। সে হাউল্লসিত। প্লেনে ওঠার আগে হাসিমুখে বলে গেল, যাক শেষপর্যন্ত শক্রদের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেল।
ছাব্বিশে মার্চের সমস্ত দিন কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারল না। শহরে কার্ফু। ঘরে বসে শুধুই প্রতীক্ষা। এর মধ্যেই আবার অবাঙালিরা যোগ দিল মিলিটারিদের সঙ্গে। বলে দিতে লাগল–কাদের কাদের শেষ করে দিতে হবে। চারদিকে মৃত্যু আর মৃত্যু।
ছাব্বিশ তারিখ ভোর এগারোটায় ইয়াহিয়ার ভাষণ প্রচারিত হলো।
… শেখ মুজিবকে বিনা বিচারে আমি ছেড়ে দেব না। আওয়ামী লীগ দেশের শত্রু। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। আমার দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশকে শত্রুমুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে। এবারও তাদের পূর্বসুনাম অক্ষুণ্ণ থাকবে…
দেশের লোক হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কী হচ্ছে এসব? কী হচ্ছে ঢাকা শহরে? কিছুই জানার উপায় নেই। ঢাকা বেতার থেকে অনবরত হামদ ও নাতে রসূল প্রচারিত হচ্ছে।
পাশের দেশ ভারত। সেখানকার বেতারেও কোনো খবর নেই। এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে গেছে, তারা কি কিছুই জানে না। কলকাতা বেতার থেকে দুপুরবেলা হঠাৎ করে গীতালি অনুষ্ঠান বন্ধ করে বলা হলো–
পূর্ববাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পূর্বপাকিস্তান রাইফেলস, পূর্ববাংলা রেজিমেন্ট, পূর্বপাকিস্তান পুলিশ, পূর্বপাকিস্তান আনসারস, পূর্বপাকিস্তান মুজাহিদ দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।
ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র বাজানো হলো সেই বিখ্যাত গান–আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। এই দেশে শুরু হলো সম্পূর্ণ নতুন ধরনের জীবনযাত্রা।
ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে মৃতদেহ পড়ে রইল। সরাবার লোক নেই।
নীলু খুব মন খারাপ করে
নীলু খুব মন খারাপ করে একা একা বসে ছিল। রাত প্রায় আটটা। চারদিক অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি আছে। তবু রান্নাঘরের বাতিটি ছাড়া আর সব বাতি নিভিয়ে রাখা হয়েছে। দাদুমণি নীলুর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, একা একা বসে আছ কেন? এসো, আমার সঙ্গে এসে বসো।
না।
ভয়ের কিছু নেই নীলু।
আমার ভয় করছে না।
সাজ্জাদরা কোথায়?
জানি না। রান্নাঘরে বোধহয়।
আমি কি বসব তোমার সঙ্গে।
জানি না, ইচ্ছা হলে বসেন।
দাদুমণি বসলেন। নিচুস্বরে বললেন, আমরা গ্রামে চলে যাব। সুযোগ পেলেই চলে যাব। নীলু কিছু বলল না। দাদুমণি বললেন, কার্ফু ওদের একসময় তুলতেই হবে। হবে না?
তুলতেই হবে কেন? না তুললে কে কী করবে?
দাদুমণি এর উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তার হাতে একটি ট্রানজিস্টার। তিনি বিদেশের রেডিও স্টেশনগুলি ধরতে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। এই ট্রানজিস্টারটি বেশি ভালো না। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এখনো হামদ ও নাতে রসূল হচ্ছে। মাঝে মাঝেই ইংরেজি বাংলা ও উর্দুতে বলা হচ্ছে–শহরে কারফিউ বলবত আছে।
সাজ্জাদ ও সাজ্জাদের বোন চুপচাপ রান্নাঘরে বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। রান্নাবান্না হয়ে গেছে। শুধু ডাল-ভাত। কিন্তু কেউ খেতে বসছে না। কারও খিদে। নেই। একসময় সাজ্জাদের বোন কী বলল, সাজ্জাদ জবাব দিল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এটা এমন একটা সময় যখন কারও কথা বলতে ইচ্ছা করে না। দেখল দাদুমণি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি নরমস্বরে বললেন, সাজা তোমরা রান্নাঘরে বসে আছ কেন? এসো সবাই একসঙ্গে বসি। নীলুকেও ডেকে এসো। ও খুবই মন খারাপ করছে।
নীলু এল না। তার নাকি কিছুই ভালো লাগছে না। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। শেষপর্যন্ত দাদুমণি এলেন তাকে নিতে।
একা একা থাকলে আরও খারাপ লাগবে।
না, লাগবে না।
তাহলে বরং খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
আমি এখন ঘুমুব না।
দাদুমণি চলে এলেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল নীলু দরজা বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে। ট্রাংক খুলে তার বাদামি রঙের খাতা বের করেছে। এখানে সে মাঝেমাঝে নিজের মনের কথা লেখে। সেই লেখাগুলি খুব গোপন। কেউ পড়তে পারে না। এমনকি দাদুমণিও না। তিনি জানেনও না যে তার এরকম একটা খাতা আছে। এটি সে জন্মদিনে পাওয়া টাকায় নিজে গিয়ে কিনে এনেছে। নীল খাতা সামনে রেখে পুরনো দুএকটা লেখা পড়ল, তারপর লিখতে শুরু করল–
২৬ মার্চ, রাত নটা
আমরা আজ সারা দিন ঘরে বন্দি হয়ে আছি। খুব খারাপ লাগছে আমার। বাইরের সব দরজা জানালা বন্ধ। বারান্দায় উঁকি দেওয়ার হুকুম নেই। এত খারাপ লাগছে। এই দেশটা লরা মেরীর দেশের মতো কেন হলো না। তাহলে কী চমৎকার হতো! ঘাসের বনে একটা ছোট্ট কুটির বানিয়ে আমরা থাকতাম। শীতকালে তুষারঝড় হতো। জানালার পাশে বসে বসে দেখতাম সাদা বরফে চারদিক ঢেকে যাচ্ছে। দাদুমণি ঘরে একটা আগুন করে মজার মজার সব গল্প বলা শুরু করতেন। বাইরে ঝড়ের মাতামাতি। কোথাও যাবার উপায় নেই। এখনো অবশ্যি কোথাও যাবার উপায় নেই। কিন্তু এই দুয়ের মধ্যে কত তফাৎ! আমার খুব খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছে