তাই নাকি?
আবার বলছেন তাই নাকি। এসব কী কাণ্ড দুলাভাই! চলেন বাসায় যাই।
যাব যাব। বসো আগে বক্তৃতাটা শুনি। বাদাম খাবে?
না।
আরে খাও না। অ্যাই, অ্যাই বাদামওয়ালা।
বাস্তবে অবশ্যি সেরকম কিছুই হলো না। কত অসংখ্য মানুষ এসেছে। কিন্তু কারও সঙ্গে কারও চেহারার কোনো মিল নাই। সাজ্জাদের হঠাৎ মনে হলো, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার তো। সব পণ্ড দেখতে একরকম। দুটি শিয়ালের মধ্যে প্রভেদ কিছু নেই। মানুষরা কত আলাদা। কেন, এরকম কেন?
সাজ্জাদ চমকে পেছন ফিরল। খয়েরি রঙের একটা চাদর গায়ে দিয়ে হেড স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। সাজ্জাদের মনে হলো, সভাতে আসার জন্যে হেড স্যার প্রথমেই একটা প্রচও ধমক দেবেন। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। স্যার অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন, সাজ্জাদ, একটা খবর শুনলাম তোমার দুলাভাইয়ের সম্পর্কে, এটা কি সত্যি? ওনাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না?
সত্যি, স্যার।
বলো কী? আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়েছ তো?
জি স্যার।
আত্মীয়স্বজন কে কে আছেন?
সাজ্জাদ চুপ করে রইল। তার তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এক মামা আছেন কুড়িগ্রামে, পোস্টমাস্টার। নিকটআত্মীয় বলতে তিনি। তার সঙ্গে বহুদিন যাবত যোগাযোগ নেই। হেড স্যার বললেন, তোমাদের চলছে কীভাবে? সঞ্চয় তো মনে হয় তেমন কিছু তোমার দুলাভাইয়ের ছিল না। নাকি ছিল? সাজ্জাদ জবাব দিল না। হেড স্যার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, কাল তুমি অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করবে। বাসা চেনো তো?
চিনি স্যার।
সকালবেলা আসবে।
জি আচ্ছা।
এখানে দাঁড়িয়ে তো কিছু শুনতে পাবে না। আরেকটু সামনে যাওয়া দরকার। চলো সামনে যাই।
আপনি যান স্যার। আমি বাসায় চলে যাব।
সে-কী! ভাষণ শুনবে না?
জি-না স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে, যাও। কাল সকালবেলা মনে করে আসবে। মনে থাকবে তো?
থাকবে স্যার।
সাজ্জাদ বাসায় গেল না। নীলুদের বাসার দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল। তার একটু লজ্জা করতে লাগল। এক সপ্তাহ পর আসছে এখানে। দাদুমণি খুব করে বলে দিয়েছিলেন একটা খবর দেওয়ার জন্যে।
দরজা খুলল নীলু। সে থমথমে গলায় বলল, খুব বকা খাবে দাদুমণির কাছে। দাদুমণি খুব রেগেছেন তোমার ওপর। আমাকে বলেছেন এলেও যেন ঢুকতে না দেই।
দাদুমণি অবশ্যি তেমন রাগ করলেন না। কিংবা রাগটা জমা করে রাখলেন, পরে করবেন। তিনি বললেন, তুমি আমি না-আসা পর্যন্ত থাকবে এখানে। আমি শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে যাচ্ছি। নীলু বলল, সে তো দাদুমণি রেডিওতে শুনলেই হয়।
না, এসব জিনিস সভাতে উপস্থিত থেকে শুনতে হয়। রেডিওতে শুধু কথাগুলি শোনা যাবে। কিন্তু বক্তৃতা শুনে মানুষের চোখেমুখে কী পরিবর্তন হচ্ছে সেটা দেখা যাবে না। আমার কাছে বক্তৃতার চেয়ে এইসব জিনিসই দেখতে ভালো লাগে।
দাদুমণি চলে যাওয়া মাত্র নীলু বলল, তোমাদের কথা আমার রোজ মনে হয়েছে। আশ্চর্য, একবারও তোমরা এলে না।
এলাম তো।
এক সপ্তাহ পর এলে। দাদুমণি যতটুকু রাগ করেছে আমি তারচেয়েও বেশি রাগ করেছি। আমি কোনো কথাই বলব না।
আমার একটা বড় বিপদ হয়েছে। আমার দুলাভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না।
খুঁজে পাচ্ছ না মানে?
কার্ফুর রাতে আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, তারপর আর ফিরে আসেননি।
সাজাদের চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করল। নীল তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। একসময় দেখা গেল সেও কাঁদতে শুরু করেছে। তার পোষা ময়না ক্রমাগত ডাকতে লাগল, কুটুম এসেছে, বসতে দাও।
ঠিক তখনই রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা শুরু করলেন। তার মুখ দিয়ে কথা বলে উঠল বাংলাদেশ।
…আমি যদি তোমাদের কাছে না থাকি, তোমাদের উপর আমার আদেশ রইল ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। রক্ত যখন দিতে শিখেছি আরও দেব। বাংলাকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।
মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে
মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে রাহেলা গম্ভীর হয়ে পড়লেন। বেশ জ্বর গায়ে। জ্বরের আঁচে গাল লাল হয়ে আছে। অথচ সকালে বেশ ভালো ছিল। অনজু ও বিলুর সঙ্গে হইচই করে খেলেছে।
কেমন লাগছে মা?
ভালো লাগছে।
মাথাব্যথা করে।
নাহ।
শরীর খারাপ লাগছে না?
না তো।
রাহেলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তুমি একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই আমরা নর্থ। ডাকোটায় চলে যাব।
আমি যেতে চাই না মা।
যেতে চাও না কেন? আমেরিকা তোমার ভালো লাগে না।
লাগে।
প্রিসিলা জবাব দিল না। ঘরের দরজায় অনজু আর বিলু উঁকি দিচ্ছিল। তাদের হাতে লুডু বোর্ড। রাহেলা বললেন, প্রিসিলার জ্বর। প্রিসিলা খেলবে না। তোমরা এখন ওকে বিরক্ত করবে না।
প্রিসিলা বলল, মা, আমি ওদের সঙ্গে খেলতে চাই।
না। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকবে।
শুয়ে থাকতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে না।
ইচ্ছে না হলেও থাকবে। আমি ডাক্তারকে টেলিফোন করছি।
রাহেলা নিচে নেমে গেলেন। নিচে গিয়ে দেখলেন, কবীর পাংশুমুখে বসে আছে একটা চেয়ারে। তার ঠোঁট কাটা, সেখানে রক্ত জমে আছে। আমিন সাহেব বসে আছেন তার সামনে। রাহেলা বললেন, কী হয়েছে?
মিছিলে গিয়েছিলাম চাচি। হঠাৎ পুলিশ তাড়া করল। দৌড়াতে গিয়ে উল্টে পড়ে গেছি।
ঠোঁট তো দেখি অনেকখানি কেটেছে।
না, বেশি না।
আমিন সাহেব বললেন, খুব মিছিল হচ্ছে, না?
খুব হচ্ছে।
ওদের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা, ঠিক না?