তারপর একবার স্কুভা ডাইভিং করতে গিয়েছেন প্রশান্ত মহাসাগরে। পানির নিচে বেশিদূর যাননি, অল্প কিছুদূর গিয়েছেন। হঠাৎ তার মনে হলো, পেছন থেকে তাঁর বাহাত ধরে কে যেন টানছে। তিনি চমকে পেছন ফিরে দেখলেন একটা দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড অক্টোপাস। অক্টোপাসটির সঙ্গে ছোট ছোট বাচ্চা। সেগুলি মার চারপাশে কিলবিল ছে। ভয়াবহ ব্যাপার!
ঘণ্টাখানেক গল্পগুজব হওয়ার পর বড়চাচা ছোটদের উঠে যেতে বললেন। হাসিমুখে বললেন, অনেকক্ষণ গল্প হয়েছে। এখন সবাই যাও। আমরা বড় কিছু কথা বলি। আজ আর পড়াশোনা করতে হবে না। আজ ছুটি।
এখন বড়দের গল্প মানেই দেশের কথা। কী হবে এই নিয়ে আলোচনা। তর্ক। এখানেও তাই হলো। সাত তারিখে কী বক্তৃতা হবে তাই নিয়ে কথা বলতে লাগলেন সবাই। বড়চাচা গম্ভীর হয়ে বললেন, শেখ সাহেব যা করছেন তার ফল ভালো হবে না। পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি দেশকে দুই ভাগ করে ফেলবার চেষ্টা করছেন।
এরকম মনে করার তো কারণ নেই। আছে কোনো কারণ? ভুট্টো সাহেবরা যা করছেন সেটাই দেশকে দুভাগ করবে। নির্বাচনে যে জিতেছে সে ক্ষমতায় যাবে, এ তো সোজা কথা।
কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই তো দেশকে দুভাগ করার চেষ্টা করবে।
করবার আগেই সেটা বলছেন কেন? অজুহাতটা খুব বাজে না? দুর্বল অজুহাত না? ধরেন, আজ যদি ভুট্টো শেখ মুজিবের মতো নির্বাচনে জিতত তাহলে কি তাকে সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী করা হতো না?
বড়চাচা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়তে লাগলেন এবং রেগে উঠতে লাগলেন। ঠিক তখন খোকন এসে বলল, বড়চাচা, আপনার সঙ্গে কথা বলব।
এখন না, পরে।
জি-না বড়চাচা, এখন। আমার সঙ্গে একটু বাইরের ঘরে আসেন। আসতেই হবে।
বড়চাচা বেশ অবাক হয়েই বাইরের ঘরে এসে দেখলেন সাজ্জাদ দাঁড়িয়ে আছে। সে তার শার্টের লম্বা হাতায় ঘনঘন চোখ মুছছে।
সাজ্জাদ না তোমার নাম? কী হয়েছে?
দুলাভাই হারিয়ে গেছেন–এই খবরটি বলতে সাজ্জাদের দীর্ঘ সময় লাগল। বড়চাচা নিঃশব্দে শুনলেন। শান্তস্বরে বললেন, কার্ফু ভঙ্গের জন্যে ধরে নিয়ে থানায় রেখে দিয়েছে। থানায় খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে। তুমি কাঁদবে না, আমি খোঁজ করছি। তুমি কিছু খেয়েছ?
জি-না।
খাও কিছু। খোকন, তোমার বন্ধুকে কিছু খাবার দিতে বলো।
আমার খিদে নেই, আমি কিছু খাব না।
সাজ্জাদ তুমি খাও। আমি খোঁজ করছি। কী নাম তোমার দুলাভাইয়ের?
শমসের আলী।
বড়চাচা প্রথমেই ফোন করলেন রমনা থানায়।
আমি মোহাম্মদ রফিক চৌধুরী। আমার একটা খবর দরকার। গত রাতে কার্ফু চলার সময়ে শমসের নামের…।
বড়চাচা সব কটি থানায় ফোন করলেন। কেউ কোনো ধরব দিতে পারল না। শমসের আলী নামের কেউ গত রাতে গ্রেফতার হয়নি। বড়চাচা ক্রমেই গম্ভীর হতে শুরু করলেন। একসময় বললেন, নিজে না গেলে হবে না। খোকন, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো। সাজ্জাদ, তুমিও চলো আমার সঙ্গে।
বড়চাচা রাত দশটা পর্যন্ত নানান জায়গায় ঘোরাঘুরি করলেন। কোনোই খবর পাওয়া গেল না। তিনি রাগী গলায় বললেন, একটা লোক আপনাআপনি নিখোঁজ হয়ে যাবে? এটা একটা কথা হলো? বড়চাচার কপালে ভাঁজ পড়ল। সাজ্জাদ ক্রমাগত চোখ মুছছে। তিনি একসময় বললেন, পুরুষমানুষদের কাঁদতে নেই। কান্না বন্ধ করো। আমি তোমার দুলাভাইকে খুঁজে বের করব। এখানকার ডিসিএমএলএ আমার পরিচিত। কাল দেখা করব তার সঙ্গে। নাকি এখন যেতে চাও? সাজ্জাদ জবাব দিল না। তিনি বললেন, চলো, এখনই যাওয়া যাক।
ডিসিএমএলএ-কে পাওয়া গেল না।
সাত তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান
সাত তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবেন রেসকোর্সের মাঠে। ভোররাত থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। দোকানপাট বন্ধ। অফিস-আদালত কিছু নেই। সবার দারুণ উল্কণ্ঠা, কী বলবেন এই মানুষটি? সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব মন দিয়ে আজ শুনতে হবে তিনি কী বলেন। আজ তাকে পথ দেখাতে হবে। শোনাতে হবে অভয়ের বাণী।
হাজার হাজার মানুষ জমতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে রেসকোর্সের ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হলো। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী সবাই অপেক্ষা করছে। বাবার কাঁধে চেপে এসেছে শিশুরা। অবাক হয়ে তারা দেখছে এই বিশাল মানুষের সমুদ্রকে।
বহুদূরে অপেক্ষা করছে সারি সারি মিলিটারি ভ্যান। চোখে সানগ্লাস পরা তরুণ অফিসারদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। সম্মিলিত শক্তি ভয়াবহ শক্তি। ওরা কি বুঝতে পারছে সে-কথা? ঘনঘন কথা বলছে ওয়ারলেসে। মাথার ওপর দিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে উড়ে যাচ্ছে হেলিকপ্টার। বিমান বাহিনীর পদস্থ অফিসাররা হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে নিচে তাকাচ্ছে। ওদের কপালেও ঘাম। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত। অপেক্ষা করছে তারাও।
সাজ্জাদ এসেছে খুব ভোরে। সে ঠিক বক্তৃতা শুনতে আসেনি। বক্তৃতা-টতা তার বিশেষ ভালো লাগে না। সাজ্জাদ এসেছে তার দুলাভাইয়ের খোঁজে। তার মনে ক্ষীণ আশা, কোনো অলৌকিক উপায়ে তাকে হঠাৎ হয়তো পাওয়া যাবে। দেখা যাবে, মাঠের প্রান্তে পা ছড়িয়ে চীনাবাদাম খাচ্ছে। সাজ্জাদকে দেখামাত্র ডাকবে, অ্যাই যে, অ্যাই এই সাজ্জাদ। সাজ্জাদ বলবে, আরে দুলাভাই, আপনি এখানে!
এলাম, দেখি শেখ সাহেব কী বলেন।
এদিকে আপনার জন্যে আমরা অস্থির। আপা বাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।