হুঁ।
কী দেখছে?
কী জানি কী? তোমার শরীর কেমন লাগছে এখন?
ভালো।
আবার বমি বমি লাগছে?
নাহ্।
বাড়িতে গেলেই দেখবে শরীর পুরোপুরি সেরে গেছে। বাড়িতে পৌঁছেই ডাক্তার আনাব। ঠিক আছে?
প্রিসিলা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। বাড়ি পৌঁছতে অবশ্যি দেরি হলো অনেক। নীলক্ষেতের সামনে সমস্ত গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে। যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কেন দেওয়া হচ্ছে না তাও কেউ বলছে না। রাহেলা অসহিষ্ণু গলায় বললেন, কী হচ্ছে?
বুঝতে পারছি না তো।
আমি অসুস্থ মেয়ে নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকব নাকি?
কিছু তো করার নেই। অপেক্ষা করা যাক। বোধহয় মিছিল-টিছিল আসছে।
আমি থাকব না এদেশে। আমি আগামী সপ্তাহেই চলে যাব।
রাহেলা কেঁদে ফেললেন।
.
খোকন বাড়ির সামনের গেটের কাছে একা একা দাঁড়িয়ে ছিল। তার খুব ইচ্ছা, সে ভয়াল-ছয়ের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু বড়চাচা বলে দিয়েছেন, কেউ যেন বাড়ি ছেড়ে কোথাও না যায়। দারোয়ন গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। বড়চাচার হুকুম, ছাড়া তালা খোলার অনুমতি নেই। খোকন আশা করে আছে সাজ্জাদ বা বল্টু এদের কেউ তার খোঁজে আসবে। কিন্তু এখনো কেউ আসছে না। আসবে জানা কথা, কিন্তু এত দেরি। করছে কেন?
ছোটচাচা যখন বেবিট্যাক্সি থেকে নামলেন তখনো খোকন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। তবু সে বুঝতে পারল না যে ছোটচাচা এসে পড়েছেন। তিনি ডাকলেন, এটা কে, খোকন না? খোকনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
আমরা যে গতকাল আসছি সে টেলিগ্রাম পাসনি?
না তো।
যা, ভেতরে গিয়ে খবর দে।
খোকনের হুঁশ ফিরে এল, সে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেল বাড়ির ভেতরে। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির প্রতিটি মানুষ বেরিয়ে এল। বহুদিন এ বাড়িতে এরকম আনন্দের ব্যাপার হয়নি।
কার্ফু ভাঙার সাথে সাথেই
কার্ফু ভাঙার সাথে সাথেই সাজ্জাদ ও বল্টু বেরিয়ে পড়ল। দাদুমণি সঙ্গে যেতে চাচ্ছিলেন ত্তি তারা কিছুতেই সঙ্গে নেবে না। তারা নাকি নিজেরাই যেতে পারবে। নালুরও দাদুমণিকে ছাড়ার ইচ্ছা নেই। বাসায় তার একা একা থাকতে ভয় লাগে।
দুজনে প্রথমে গেল বন্দুদের বাসায়, কাওরান বাজারে। বাসায় তখন প কান্নাকাটি হচ্ছে। তার মা সারা রাত কেঁদেছেন। তিনবার ফিট হয়েছেন। বাবা মা পাশেই একটা মোড়াতে বসে আছেন। বল্টুর বড় দুভাই কার্ফু ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল নিয়ে খুঁজতে বের হয়েছে। মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন। বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আগামী রোববারেই আমি ছুটি নিয়ে সবাইকে দেশের বাড়িতে রেখে আসব। ঝামেলা না মিটলে কাউকে ফিরিয়ে আনব না। বলতে বলতে তিনিও চোখ মুছতে লাগলেন।
সাজ্জাদ কী করবে ভেবে পেল না। চলে যাবে না আরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? কাউকে কিছু না বলে চলে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। আবার এরকম কান্নাকাটির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভালো লাগে না। বল্টুর বাবা বললেন, সাজ্জাদ, তুমি আর এ বাড়িতে আসবে না। তোমার পাল্লায় পড়ে ছেলের আজ এই অবস্থা। বুঝতে পারছ? সাজ্জাদ মাথা নাড়ল।
যাও, এখন বাড়ি যাও। দাঁড়িয়ে আছ কেন?
সাজ্জাদদের বাসা তেজকুনিপাড়া। সে থাকে তার বোন এবং দুলাভাইয়ের সঙ্গে। দুলাভাই লেদ মেশিন ওয়ার্কশপের একজন মেকানিক। লোকটি নিরীহ গোছের। সে নিশ্চয়ই সাজ্জাদকে দেখে তেমন কিছু বলবে না। হয়তো বলবে, এই রকম ঘোরাফেরা করা ঠিক না। আর যাবে না। অবশ্যি তার বোন খুবই রাগ করবে। আজ সারা দিন হয়তো কথাই বলবে না। ঘনঘন চোখ মুছবে।
সাজ্জাদ তাদের বাসার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কান্নাকাটির শব্দ শোনা যায় কি না। কোনো শব্দ নেই। কেউ কাঁদছে না। সে ঘরে ঢুকে দেখল তার বোন রান্নাঘরে। সাজ্জাদকে দেখেই সে বলল, তোর দুলাভাই কোথায়?
আমি তো জানি না।
তুই জানিস না মানে? তোর খোঁজে সেই সন্ধ্যাবেলা গেছে, আর তো আসে নাই।
কার্ফুর মধ্যে কোথায় গেল? আমি বললাম যাওয়ার দারকার নেই। তবু গেল।
সাজ্জাদের বোন সরুগলায় বলল, এখন কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে। বোকাসোকা মানুষ।
ফার্কুর মধ্যে আটকা পড়েছে আর কী। আসবে, আসবে এখুনি।
তারা দুই ভাইবোন দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কেউ এল না। সাজ্জাদের বোন কান্নাকাটি কিছুই করল না। সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরের কাজ করতে লাগল। দুপুরের পর সাজ্জাদ খুঁজতে বেরুল।
তখন শহরে মিছিলের পর মিছিল বেরুচ্ছে। উত্তেজিত মানুষের মুখে একটিমাত্র কথা–শেখ সাহেবের ভাষণ হবে ৭ তারিখে। সেই ভাষণে দারুণ একটা কিছু বলবেন তিনি।
সাজ্জাদ নানান জায়গায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াল। ফার্মগেট, নীলক্ষেত, আজিমপুর। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে শুনল তার বোন ক্ষীণস্বরে কাঁদছে। দুলাভাই এখনো ফিরেননি।
চায়ের জমকালো আয়োজন
খোকনের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা চায়ের একটা জমকালো আয়োজন করা হয়েছে। খোকনের মা এবং প্রিসিলা ছাড়া আর সবাই এসে বসেছে খাবার টেবিলে। প্রিসিলার জর কমে গিয়েছে, তবে দুর্বল হয়ে গেছে। বিকেল থেকেই সে ঘুমুচ্ছে। খোকনের একজন মামা পিজির বড় ডাক্তার। তিনি এসে দেখে গিয়েছেন এবং বলেছেন, তেমন কিছু নয়। ট্রাভেল সিকনেস। দুএকদিন পুরোপুরি রেস্টে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।
চায়ের টেবিলে ছোটরা কোনো কথা বলতে পারে না। কিন্তু আজ সবাই কথা বলছে। বড়চাচার মুখ হাসি হাসি। তার হাসি দেখেই মনে হচ্ছে আজ আর তিনি রাগ করবেন না। ছোটচাচা একটির পর একটি মজার মজার গল্প বলে যাচ্ছেন–একবার বেড়াতে গিয়েছিলেন আলাস্কা। সেখানে ঠান্ডায় নাকি হঠাৎ তার চোখের মণি জমে গেল। কিছুই দেখতে পান না। শেষকালে হাতের তালু দিয়ে চোখ ঘষে ঘষে গরম করার পর আবার দেখতে পেলেন।