আমিও তাই ভেবেছিলাম। বাসার জন্যেও পহয় একটু খারাপ লাগছে। লাগছে?
লাগছে।
বাসায় তোমার কে কে আছেন?
আব্বা, আম্মা আর দাদি।
সকাল হলেই ওরা কার্ফু তুলে নেবে। তখন সবার আগে আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব। কেমন?
বল্টু মাথা নাড়ল।
একটা তো মোটে রাত। দেখাত দেখতে কেটে যাবে। মাঝে মাঝে দেশের খুব বড় দুঃসময় আসে। তখন দেশের মানুষকে কষ্ট করতে হয়। এই যেমন আমরা করছি।
দাদুমণি কিছুক্ষণ থেমে থেকে মৃদুস্বরে বললেন, এই গণ্ডগোল, মিছিল কেন হচ্ছে তোমরা জানো?
জানি।
কেন হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেছে, সেইজন্যে।
কিন্তু এর আগেও তো আমরা অনেক মিছিল-টিছিল করেছি। করিনি?
করেছি।
সেগুলি কী জন্যে করেছি জানো?
সবাই চুপ করে রইল। দাদুমণি বললেন, তোমাদের এসব জানা উচিত। চোখের সামনে এত বড় একটা অন্দোলন হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানা উচিত না?
জি।
আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি; গোড়ার কথাগুলি অনেকেই জানে না। সমগ্র পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে, এই জিসিটা জানো?
না।
একধরনের মানুষ হচ্ছে শোষক, যারা শোষণ করে। আর অন্যধরনের মানুষ হচ্ছে শোষিত। অর্থাৎ এদের শোষণ করা হয়। পাকিস্তানের জন্ম হলো মুসলমানদের নিয়ে। তখন শোষিত মানুষ ভাবল আর তাদের দুঃখকষ্ট থাকবে না। এইবার সুখ আসবে।
সুখ কিন্তু এল না। কারণ পাকিস্তানেও একদল আছে যারা শোষক। তারা ধনী, তাদের হাতে ক্ষমতা আছে। এদের বেশিরভাগই হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি। দেশের রাজধানীও তার অংশে। কাজেই তারা জোরেসোরে শোষণ শুরু করল। এবং আমরা পূর্বপাকিস্তানের মানুষরা হলাম শোষিত। আমাদের শোষণ করতে লাগল তারা যাতে কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি। কাজেই আমরা তাদের ঘৃণা করতে শুরু করলাম। আমাদের এই ঘৃণা তারা কখন প্রথম বুঝতে পারল জানো?
না, কখন?
ভাষা আন্দোলনের সময়।
ভাষা আন্দোলনের সময় তাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। তখন তারা বুঝতে পারল, আরে পূর্বপাকিস্তানের এই মানুষগুলি তো সহজ পাত্র নয়। কাজেই তারা এখন খুব সাবধান। এবং আমার কী মনে হয় জানো? আমার মনে হয় এরা কিছুতেই শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা দেবে না।
সাজ্জাদ হঠাৎ বলে বসল, আমাদের হাতে ক্ষমতা আসলে আমরাও কি শোষক হয়ে যাব?
যেতে পারি। হয়তো দেখা যাবে আমরা তখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ করতে শুরু করেছি। তখন হয়তো তারাও আন্দোলন শুরু করবে।
নীলু বলল, এসব শুনতে ভালো লাগছে না দাদুমণি। একটা ভূতের গল্প বলো।
দাদুমণি বললেন, এখন আর ভূতের গল্প বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ঠিক তখন কারেন্ট চলে গিয়ে চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। উত্তরদিক থেকে খুব হইচই হতে লাগল। দাদুমণি দরজা খুলে কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ফিরে এসে বললেন, কোথায় যেন আগুন লেগেছে, উত্তরদিকে। বিরাট আগুন।
রাতের ভাত খাওয়ার সময় রেডিওতে বলল লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্বপাকিস্তানে আসছে।
বল্টু আবার কাঁদতে শুরু করল। দাদুমণি বললেন, কী হয়েছে বল্টু? পেট ব্যথা করছে।
না, বাসার জন্যে খারাপ লাগছে।
কার্ফু উঠলেই আমি তোমাকে বাসায় দিয়ে আসব।
বল্টু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, যদি কার্ফু না ওঠে?
কার্ফু তোলা হলো
কার্ফু তোলা হলো সকাল নটায়।
চারদিকে কেমন ছমছমে ভাব। যেন কিছু একটা হবে। কী হবে কেউ ভাল কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। যুবকদের চেহারা একই সঙ্গে রাগী ও বিষণ্ণ।
এয়ারপোর্টে আমিন সাহেব মেয়েকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ডাক্তার ভদ্রলোক বললেন, বাসায় না গিয়ে মেয়েকে সরাসরি কোনো হাসপাতালে নিয়ে যান। বডি ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছে। রাহেলা অস্থির হয়ে পড়েছেন, এতক্ষণেও নেওয়ার কোনো গাড়ি আসছে না কেন? তিনি বললেন, গাড়ি লাগবে না, চলো একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই।
এত মালপত্র কী করব?
পড়ে থাকুক।
বেবিট্যাক্সি, রিকশার সংখ্যা খুব কম। বহু কষ্টে একটি জোগাড় করা গেল। রাস্তায় যানবাহন তেমন নেই। কিন্তু প্রচুর মানুষ। ছোট ছোট দল বানিয়ে জটলা পাকাচ্ছে। রাস্তার প্রতিটি মোড়ে ইপিআর-এর বড় বড় ভ্যান। ভ্যানের মাথায় মেশিনগান বসিয়ে সৈন্যরা অপেক্ষা করছে। আমিন সাহেব বললেন, দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র। রাহেলা, অবস্থা দেখো।
তুমি দেখো। আমার দেখার শখ নেই।
এত সৈন্য নামিয়েছে শহরে, আশ্চর্য!
প্রিসিলা বলল, বাবা, আমি সৈন্য দেখব। রাহেলা ধমক দিলেন, সৈন্য দেখতে হবে। শুয়ে থাকো। আমিন সাহেব বললেন, ওকে দেখতে দাও। দেখে অভ্যস্ত হোক। এ দেশের অবস্থা জানতে হবে না তাকে।
না, জানার দরকার নেই। আমি এখানে থাকব না।
কোথায় যাবে?
আমেরিকা। যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাব।
আমিন সাহেব কিছু বললেন না। রাহেলা বললেন, এরকম দেশে মানুষ থাকতে পারে।
কেন, মানুষ থাকছে না? ওরা থাকতে পারলে আমরাও পারব। তাছাড়া অবস্থা এরকম থাকবে না।
কী করে তুমি জানো থাকবে না?
এটা জানা যায়। সব খারাপ সময়ের পর আসে সুসময়।
সুসময় আসুক আর যাই আসুক, আমি এখানে থাকব না। তুমি যেতে না চাও থাকবে। আমি প্রিসিলাকে নিয়ে চলে যাব।
আমিন সাহেব কিছু বললেন না।
ফার্মগেটের সামনে এসে দেখা গেল প্রতিটি গাড়িকে থামানো হচ্ছে। দুজন মিলিটারি এসে উঁকি দিচ্ছে প্রতিটি গাড়িতে। কাউকে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করছে। আমিন সাহেবকে অবশ্যি কিছু বলল না। হাত দিয়ে ইশারা করে চলে যেতে বলল। প্রিসিলা বলল, ওরা মিলিটারি, বাবা?