- বইয়ের নামঃ সূর্যের দিন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
এ বাড়ির নিয়ম
এ বাড়ির নিয়ম হচ্ছে যাদের বয়স চৌদ্দর নিচে, তাদের বিকেল পাঁচটার আগে ঘরে ফিরতে হবে। যাদের বয়স আঠারোর নিচে, তাদের ফিরতে হবে ছটার মধ্যে।
খোকনের বয়স তেরো বছর তিন মাস। কাজেই তার বাইরে থাকার মেয়াদ পাঁচটা। কিন্তু এখন বাজছে সাড়ে সাতটা। বাড়ির কাছাকাছি এসে খোকনের বুক শুকিয়ে তৃষ্ণা পেয়ে গেল। আজ বড়চাচার সামনে পড়ে গেলে ভূমিকম্প হয়ে যাবে।
অবশ্যি চমৎকার একটি গল্প তৈরি করা আছে। খোকন ভেবে রেখেছে সে মুখ কালো করে বলবে, সাজ্জাদের সঙ্গে স্কুলে খেলছিলাম, হঠাৎ দেখলাম বিরাট একটা মিছিল আসছে। সবাই খুব স্লোগান দিচ্ছে, জাগো বাঙালি জাগো। আমরা দূর থেকে দেখছি। এমন সময় গণ্ডগোল লেগে গেল। পুলিশের গাড়ির ওপর সবাই ইটপাটকেল মারতে লাগল। চারদিকে হইচই, ছোটাছুটি। আমি সাজ্জাদকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে লাগলাম। পেছনে চারদিকে পটাপট শব্দ হচ্ছে, বোধহয় গুলি হচ্ছে। আমরা আর পেছন ফিরে তাকাইনি, ছুটছি তো ছুটছিই। ফিরতে দেরি হলো এইজন্যে।
খুবই বিশ্বাসযোগ্য গল্প। আজকাল রোজই মিছিল হচ্ছে। আর রোজই গণ্ডগোল হচ্ছে। মিছিলের ঝামেলায় পড়ে যাওয়ার কথা সবাই বিশ্বাস করবে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বড়চাচাকে ঠিক সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ফেলা যায় না। তার সম্ভবত তিন নম্বর চোখ বলে কিছু আছে যা দিয়ে তিনি অনেকদূর পর্যন্ত দেখে ফেলেন। কথা বলতে শুরু করেন অত্যন্ত নিরীহ ভঙ্গিতে। ভাবখানা এরকম যেন কিছুই জানেন না। সেবারের ঘটনাটাই ধরা যাক। ফজলুর পাল্লায় পড়ে ফার্স্ট শো সিনেমা (গোলিয়াথ অ্যান্ড দ্য ড্রাগন, খুবই মারাত্মক ছবি দেখে বাড়িতে পা দেওয়ামাত্র বড়চাচার সামনে পড়ে গেল। বড়চাচা হাসিমুখে বললেন, এই যে খোকন, এইমাত্র ফিরলে বুঝি?
জি চাচা।
একটু মনে হয় দেরি হয়ে গেছে।
অঙ্ক করছিলাম।
তাই নাকি?
জি। ফজলুর এক মামা এসেছেন। খুব ভালো অঙ্ক জানেন। উনি দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
পাটিগণিত?
জি পাটিগণিত। পাটিগণিতই উনি ভালো জানেন। তৈলাক্ত বাশের অঙ্কটা আজ খুব ভালো বুঝেছি।
বড়চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, একটা মুশকিল হয়ে গেল খোকন। তোমার দেরি দেখে ফজলুদের বাসায় লোক পাঠানো হয়েছিল। সে কিন্তু তোমাদের দেখতে পায়নি।
খোকন মহা বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। এবারও পারল। হাসিমুখে বলল, আমরা তো ফজলুর বাসায় অল্প করছিলাম না। ওদের বাসায় খুব গণ্ডগোল হয় তো, তাই আমরা জহিরদের বাসায় গেলাম।
এটা ভালোই করেছ। পড়াশোনা করার জন্যে নিরিবিলি দরকার। ফজলুর মামা যে তোমাদের জন্যে এতটা কষ্ট স্বীকার করেছেন সেজন্যে তুমি তাকে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিয়ো।
জি চাচা, দেব।
আর তুমি তাকে আগামীকাল আমাদের বাসায় চা খেতে বলবে। তুমি নিজে গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসবে, কেমন?
খোকন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বড়চাচা চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে বললেন, খোকন, কী সিনেমা দেখলে।
এই হচ্ছেন বড়চাচা। এরকম একজন মানুষের ভয়ে যদি কারও বুক কাঁপে তাহলে বোধহয় তাকে ভীরু বা কাপুরুষ বলা ঠিক হবে না। খোকন এই ঠান্ডার মধ্যেও ঘামতে লাগল।
তবে একতলার সবচেয়ে বাঁ-দিকের ঘরটিতে আলো জ্বলছে। এটা একটা সুলক্ষণ। এর মানে হচ্ছে বড়চাচার কাছে মক্কেল এসেছে। তিনি মামলার নথিপত্র নিয়ে ব্যস্ত। খোকন এত রাত পর্যন্ত বাইরে এটা বোধহয় এখনো ধরতে পারেননি। যা হওয়ার হবে। খোকন খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু আশ্চর্য, কিছুই হলো না। সবাই যেন কেমন খুশি খুশি। উৎসব উৎসব একটা ভাব। ছোটরা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কেউ তাদের বকছে না। বড়চাচি পান বানাতে বানাতে কী একটা গল্প বলে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। ঈদের আগের রাতে যেরকম একটা আনন্দভাব থাকে, চারদিকের অবস্থা সেরকম। কিছু ঘটেছে, কিন্তু এখনই কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। খোকন এমন ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল যেন সে সারাক্ষণ বাড়িতেই ছিল। অনজু আর বিলু সাপলুডু খেলছিল। ওদের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। বিলুটা মহা চোর। তার পড়েছে চার কিন্তু সে পাঁচ চেলে তরতর করে মই বেয়ে উঠে গেল। পরেরবার উঠল পাঁচ, একেবারে সাপের মুখে। সে আবার চালল চার। অনজুটা এমন বোকা কিছুই বুঝতে পারছে না। খোকন বলল, এসব কী হচ্ছে বিলু?
কিছুই হচ্ছে না। তুমি মেয়েদের খেলায় কথা বলতে এসেছ কেন? কোথায় ছিলে সারা সন্ধ্যা?
ঘরেই ছিলাম। যাব আবার কোথায়?
খোকন সেখানে আর দাঁড়াল না। চলে এল দোতলায়। বাবার ঘরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, প্যাথলজি শব্দের মানে কী? যাতে বাবা বুঝতে পারেন সে পড়াশোনা নিয়েই আছে।
বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করা মুশকিল। তিনি অল্পকথায় কোনো জবাব দিতে পারেন। প্যাথলজি শব্দের মানে বলতে তিনি পনেরো মিনিট সময় নিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা বললেন, ভেষজবিজ্ঞানের ইতিহাস বললেন, শারীরবিদ্যায় প্রাচীন গ্রিকদের অবদানের কথা বললেন। খোকন চোখ বড় বড় করে শুনল। তার ভঙ্গিটা এরকম যেন সে খুব মজা পাচ্ছে। বাবা বক্তৃতা শেষ করে বললেন, যা যা বললাম সব খাতায় লিখে রাখবে।