অনেক দিন পর রাতে তিনি আরাম করে খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় ঘুমুতে গেলেন। রফিক পায়ে লোসন ঘসে দিচ্ছে। আরামে তাঁর শরীর ঝিম ঝিম করছে। ঘুমিয়ে পড়লে আরামটা পাওয়া যাবে না বলে তিনি কষ্ট করে জেগে আছেন। তাঁর হাতে মধ্যরাতের হাসি নামের বই। কাহিনী অত্যন্ত জমাট। শহরতলির এক হোটেলে কুদ্দুস নামের একজন ক্যানভাসার রাত কাটাতে গেছে। সে যতবার বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে যায় ততবার আপনাআপনি বাতি জ্বলে উঠে। বাথরুমের সিংকেও সমস্যা। আপনাআপনি পানি পড়ে। সে কল বন্ধ করে বিছানায় শোয়ামত্রি কল দিয়ে পানি পড়তে থাকে।
কুদ্দুস গেল হোটেলের রিসিপশনে বসা ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেইন করতে। সেখানে আরেক কাণ্ড।
ম্যানেজারের জায়গায় অতি রূপবতী এক তরুণী বসে আছে। তরুণীর বয়স ষোল সতেরো। পরনের শাড়ির রঙ লাল। গা ভর্তি গহনা। তার গাত্রবর্ণ দুধে আলতায়। তরুণী কুদ্দুসকে দেখে বলল, স্যার কয়টা বাজে?
কুদ্দুস বলল, বারোটা বাজতে এক মিনিট বাকি।
তরুণী বলল, স্যার তাড়াতাড়ি ঘরে চলে যান। বারোটা বাজলে একটা ঘটনা ঘটবে। আপনি ভয় পেতে পারেন।
কুদ্দুস বলল, কী ঘটবে?
সানাউল্লাহ বই পড়া বন্ধ করলেন। তার ভয় ভয় লাগছে। বারোটা বাজরে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে এটা বুঝা যাচ্ছে। অতিরিক্ত ভয় পেলে ঘুম চটে যেতে পারে। তারচেয়ে রফিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প গুজব করা যেতে পারে। সে এখনো ক্ষমা চায় নি এটাও এক সমস্যা। তাকে দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো দরকার।
রফিক।
জি স্যার।
মানুষ ভুল করে। করে না?
অবশ্যই করে। তয় নিজের ইচ্ছায় করে না।
কার ইচ্ছায় করে?
শয়তানের ইচ্ছায় করে। মানুষের কোনো দোষ নাই। সব দোষ শয়তানের।
শয়তানের ঘাড়ে সব চাপিয়ে দিলে তো হবে না রফিক।
শয়তানের ঘাড়ে চাপাব না তো কার ঘাড়ে চাপাব?
সানাউল্লাহ হতাশ গলায় বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে এই নিয়ে পরে আলাপ হবে। আরেকটা কথা বলে রাখি যদি কখনো দেখিস এই বাড়িতে দুটা ভূতের বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে— ভয় পাবি না।
রফিক বলল, ভয় পাব কি জন্যে? আমার দেশের বাড়িতে যাইতে হয় গোরস্থানের কিনার দিয়া। গভীর রাত্রে বাড়ি যাইতাছি হঠাৎ তাকায় দেখি গোরস্থানের তালগাছ সমান উঁচা এক লোক। বুঝলাম জিন।
জিনটা কি করল?
কিছুই করল না। সে তার মতো গোরস্তানে হাঁটাহাটি করতে লাগল— আমি আস্তে বাড়ি চইলা আসলাম।
রফিক বলল, না।
ডরাইলেই ডর। না ডরাইলে কিসের ডর?
সকাল আটটা বাজার আগেই
সকাল আটটা বাজার আগেই, হামিদুর রহমান উপস্থিত। সানাউল্লাহ তখন নাশতা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন। আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। সিগারেট তিনি খান না। রফিক এক প্যাকেট কিনে এনেছে। প্যাকেটটা রেখেছে রান্নাঘরের ফ্রিজের ওপর। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, সিগারেট তো খাই না। তুই সিগারেট আনলি কেন?
রফিক বলল, টেকার ভাংতি পাই না এইজন্যে কিনলাম। কোনোদিন যদি মন মিজাজ খুব খারাপ থাকে একটা টান দিবেন। আবার যদি মন মিজাজ খুব ভালো থাকে আরেকটা টান দিবেন। গেল ফুরাইল।
সানাউল্লাহুর মন মেজাজ অজি অতিরিক্ত ভালো, সেই হিসেবে সিগারেট ধরিয়েছেন। হামিদকে দেখে তার কলিজা অনেকখানি শুকিয়ে গেল। হামিদ অতি পঁাচ খেলা লোক। হামিদের কথাই তিনি তার বন্ধু আবু করিমকে বলেছিলেন। স্বভাব গিরগিটির মতো। সরকার বদলের সঙ্গে দলবদল। নিজের ক্যাডার বাহিনী আছে। এদের দিয়ে তিনি যাবতীয় কুকর্ম করান।
হামিদ, সানাউল্লাহ্র খালাতো ভাই। যখন সানাউল্লাহর স্ত্রী জীবিত ছিলেন তখন বিপদেআপদে হামিদকে ডাকতেন। এখন যোগাযোগ নেই। হামিদ সানাউল্লাহর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে কড়া গলায় বললেন, সিগারেট ফেল। সকালবেলা বিষ হাতে নিয়ে বসে আছ। সিগারেটের আরেক নাম যে Death stick তা জানো?
না।
এখন জানলে। সিগারেট ফেল।
সানাউল্লাহ্ আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিলেন। হামিদ বুকপকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন! গত রাতে জাবিনের সঙ্গে টেলিফোনে তাঁর কথা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলি তিনি কাগজে লিখে রেখেছেন। তাঁর আলজিয়ার্সের মতো হয়েছে। অনেক কথাই মনে থাকে না। কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে। ওয়ার্ড কমিশনারদের এক মিটিং। মেয়র সাহেবের খাসকামরায় মিটিং শুরু হয়েছে। তখন তিনি ভুলে গেলেন তার দল কী। তিনি কি বিএনপির না-কি আওয়ামী লীগের। বক্তব্য দিতে হলে দল বিবেচনা করে দিতে হবে। আওয়ামী লীগ হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন দিয়ে শুরু করতে হবে। তিনি বিএনপির কেউ হলে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়ার আদর্শ নিয়ে শুরু করতে হবে। এত বড় একটা মিটিং হলো, অথচ তিনি কোনো কথাই বলতে পারলেন না। মেয়র সাহেব এক পর্যায়ে বললেন, হামিদ সাহেব! আজ দেখি আপনি চুপচাপ। কিছু বলবেন?
হামিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কিছু বলব না।
হামিদ হাতের কাগজের দিকে তাকালেন। প্রথমেই লেখা— ব্যাটারি খাওয়া। এ থেকে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। আরো বিস্তারিত ভাবে লেখা উচিত ছিল। জাবিনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন সবই পানির মতো পরিস্কার ছিল। এখন সব ঘোলাটে লাগছে।
হামিদ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, গত রাতে জাবিন মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। সে কিছু বিষয় নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত। আমাকে বলেছে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এখন বলো ব্যাটারি খাওয়া বিষয়টা কী? কোনো কিছু গোপন করবার চেষ্টা করবে না। আজ পর্যন্ত কেউ তথ্য গোপন করে আমার কাছ থেকে পার পায় নাই। বলো ব্যাটারি খাওয়াটা কী?