জাবিন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এইসব কী বলছেন চাচা! বাবা মার্ডার করবে কেন?
হামিদ বললেন, করলেও সমস্যা নাই। আমি আছি না? আমার উপর ভরসা রাখতে বল। আগরতলা পৌঁছামাত্র তার রেশন কার্ড হয়ে যাবে। ভোটার তালিকায় নাম উঠানোর ব্যবস্থা করব। ইন্ডিয়ান নাগরিক হিসাবে বাকি জীবন সেখানে থাকবে। হিন্দু ব্রাহ্মণ! নাম হরি ঠাকুর।
জাবিন বলল, চাচা, আপনার মাথা তো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
হামিদ বললেন, নষ্ট হবার পথেই ছিল। ব্যাটারি চিকিৎসার কারণে এখনো কিছুটা কনট্রোলের মধ্যে আছে। ভালো কথা, তোর বাবা কাকে মার্ডার করেছে? গুরুত্বপূর্ণ কেউ না তো?
জাবিন বাসায় ফিরল সন্ধ্যার দিকে। মাসুদ বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছে। তার মুখ থমথমে। চোখের দৃষ্টিতে ভরসা হারা ভাব। জেট লেগের কারণে ঘুমে চোখে জড়িয়ে আসছে, তারপরেও সে জেগে আছে। জাবিনের সঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার। বারান্দায় বসে জাবিনের সঙ্গে কথাবার্তা কি হবে তার রিহার্সেল দুবার দিয়েছে। রিহার্সেলে মনে হয় কাজ হবে না। আসল সময়ে এলোমেলো হয়ে যাবে। তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
জাবিন বারান্দায় উঠে এসে বলল, হ্যালো।
মাসুদ তার পাশের চেয়ার দেখিয়ে বলল, জাবিন! কথা আছে বসো।
জাবিন বসতে বসতে বলল, দুপুরে ঠিকমতো খেয়েছ?
মাসুদ বলল, আচার দিয়ে একগাদা ভাত খেয়েছি। প্রতিটি আইটেম সুস্বাদু ছিল।
জাবিন বলল, গুড।
কিসের আচার দিয়ে ভাত খেয়েছি জানতে চাও?
জাবিন বলল, জানতে চাচ্ছি না। তুমি আরাম করে খেয়েছ এটা ইম্পর্টেন্ট। আমের আচার দিয়ে খেয়েছ না-কি মরিচের আচার দিয়ে খেয়েছ সেটা ইম্পর্টেন্ট না।
মাসুদ ঠাণ্ডা গলায় বলল, ইম্পর্টেন্ট। আমি পিঁপড়ার আচার দিয়ে খেয়েছি। কালো পিঁপড়ার আচার।
কী বললে?
কি বলেছি তুমি শুনেছ। দ্বিতীয়বার বলতে পারব না। আমি তোমার বাবাকে বিপদজনক মানুষ বলেছিলাম বলে তুমি রাগারাগি করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে। এখন বুঝেছ কেন বিপদজনক বলেছি? যে মানুষের ঘরে তিন বোতল পিঁপড়ার আচার সে কি বিপদজনক না।
জাবিন চুপ করে রইল। মাসুদ বলল, একজন সাধু পুরুষ আসেপাশে সাধু নিয়ে চলাফেরা করে। একজন বিপদজনক মানুষের আশেপাশে থাকে বিপদজনক মানুষ। কাজের ছেলে রফিক হচ্ছে তার উদাহরণ।
সে কী করেছে?
আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে চলে গেছে। কাগজে কী লেখা পড়ে দেখ। মাসুদ পকেট থেকে কাগজ বের করে জাবিনের হাতে দিল। সেখানে লেখা
দুলাভাই,
সালাম নিবেন। আপনার সাথে আমার পুষতেছে না। কাজেই চলিয়া গেলাম। স্যার ফিরত আসিলে আবার আসিব ইনশাল্লাহ।
ইতি
রফিক মিয়া
জাবিন বলল, রফিক চলে গেছে?
মাসুদ বলল, খালি হাতে যায় নি। আমার হ্যান্ডব্যাগ এবং একটা স্যুটকেস নিয়ে চলে গেছে। এই ছেলে আগেও চুরি করেছে। তোমার পিতা সব জেনেশুনে তাকে আবার রেখেছেন। কারণ তিনি বিপদজনক মানুষ। তিনি বিপদ পছন্দ করেন।
জাবিন বলল, বার বার বিপদজনক মানুষ বিপদজনক মানুষ বলার তো দরকার নেই। একবার বলেছ শুনেছি।
মাসুদ বলল, তোমার প্রতি আমার সাজেশন হচ্ছে— তুমি বাংলাদেশে তোমার বাবার সঙ্গে থেকে যাও। মহাবিপদ টেনে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাবার কিছু নেই। তুমি দেশে থেকে বাবার সেবা কর। তোমার ভূত ভাই এবং ভূত বোনের সঙ্গে সময় কাটাও। তোমার জন্যে ভৌতিক পরিবারই দরকার।
জাবিন বলল, কী বলতে চাচ্ছ পরিষ্কার করে বলো। তুমি আমার সঙ্গে বাস করতে চাচ্ছ না?
মাসুদ বলল, আমাদের আলাদা থাকাই বাঞ্চনীয়। তোমার সঙ্গে থাকা মানে তোমার পিতার সান্নিধ্যে থাকা। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। কিছু মনে করো না, আমি চলে যাচ্ছি একটা হোটেলে গিয়ে উঠব।
জাবিন বলল, আমি কী করব?
মাসুদ বলল, তুমি তোমার বাবার বাড়ি পাহারা দেবে। ভূত ভাইবোনদের নিয়ে সাপলুড়ু খেলবে।
জাবিন বলল, সামান্য একটা পিঁপড়ার আচার খেয়ে তোমার এই অবস্থা? মাসুদ কঠিন গলায় বলল, পিঁপড়ার আচার হয়তো সামান্য, কিন্তু পিঁপড়ার আচারের উদ্ভাবক সামান্য না। তিনি অসামান্য। আমি অসামানার সঙ্গে নেই। তাছাড়া পুলিশ উনাকে খুঁজছে। উনাকে না পেয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের পুলিশ এই কাজটা করে। মূল আসামিকে না পেলে আত্মীয়স্বজন ধরে নিয়ে রিমান্ডে পাঠিয়ে দেয়। আমি হোটেল সোনারগাঁয়ে রুম বুক করেছি, ছয়শ তেইশ নাম্বার রুম। তুমি যদি তোমার বিপদজনক বাবার কথা ভুলে গিয়ে আগামী পরশু অস্ট্রেলিয়া ফেরত যেতে রাজি থাক, তাহলে হোটেলে চলে আস। চিন্তা করার জন্যে তোমাকে বারো ঘণ্টা সময় দিলাম।
জাবিন বলল, ইউ গো টু হেল।
মাসুদ বারান্দা থেকে নামল। শান্ত ভঙ্গিতে গেট পার হয়ে রাস্তায় নামল। ইয়েলো ক্যাব ডেকে উঠে পড়ল।
জাবিন প্রথম কিছুক্ষণ কাঁদল। চেষ্টা করল বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার। রিং হয় কেউ ধরে না। খালি বাড়িতে তার ভয় ভয় করতে লাগল। শেষে তার হামিদ চাচাকে টেলিফোন করে বলল, চাচা, আমাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যান।
হামিদ সব কথা শুনে বিরক্ত গলায় বললেন, কান্নাকাটি বন্ধ কর তো মা। জামাইকে টাইট দেবার ব্যবস্থা করছি। এক ট্রিটমেন্টে তোর জামাই সরলরেখা হয়ে যাবে।
তুমি কী করবে?
আমি কী করব সেটা আমার ব্যাপার। তুই আজ সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়। কলি তোর অনেক কাজ।
কী কাজ?
হামিদ বললেন, কাল আমি কাকভোজন করাচ্ছি। ঢাকা শহরের যত কাক আছে সবাইকে তেহারি খাওয়ানো হবে। বাবুর্চি হাজি কাল্লু মিয়া রাঁধবেন। তুই থাকবি তদারকিতে।