পত্রিকা কোলে নিয়ে জাবিন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। জাবিনের পাশে তার স্বামী মাসুদ। রফিক দুজনকেই চা দিয়েছে। জাবিন চায়ের কাপে চুমুক দেয় নি। মাসুদ তৃপ্তির সঙ্গেই চা খাচ্ছে। মাসুদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিছু মনে করো নী। তোমার বাবা অতি বিপদজনক একজন ব্যক্তি।
জাবিন বলল, আমার বাবা বিপদজনক ব্যক্তি?
হ্যাঁ। তুমি আমার কথায় রাগ করবে, তারপরেও বলি–যে মানুষ দেশে বিপদজনক সে বিদেশেও বিপদজনক।
জাবিন বলল, তুমি চাচ্ছ না যে আমার বাবা বিদেশে যাক? সে তার মেয়ের সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাক।
মাসুদ বলল, আমার অনেস্ট ওপিনিয়ন হলো No. তিনি যে ধরনের মানুষ তাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হবে। সেই সময় তোমার নেই। আমারও নেই।
জাবিন বলল, আমার চার বছর বয়সে মা মারা গেলেন। বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন নি। আমাকে একা বড় করেছেন। তিনি তার জীবনটা দিয়ে দিলেন আমার জন্যে। তার উত্তরে আমি কী করলাম? বাবাকে ফেলে রেখে বিদেশে সুখের সংসার পাতলাম।
মাসুদ বলল, ইমোশনাল কথাবার্তা বলার তো এখানে কিছু নাই। পুরো ব্যাপারটা আমাদের র্যাশনালি দেখতে হবে। তোমার বাবার আছে তার জীবন। আমাদের আছে আমাদের জীবন।
জাবিন চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল। রফিককে বলল, রফিক! আমার জন্যে একটা ইয়েলো ক্যাব নিয়ে এসো।
মাসুদ বলল, কোথায় যাচ্ছ?
জাবিন বলল, হামিদ চাচার কাছে যাচ্ছি। বাবার ঘটনাটা কী জানি।
চল আমিও যাচ্ছি।
জাবিন বলল, তোমাকে যেতে হবে না। বাবা যে কী পরিমাণ বিপদজনক মানুষ এটা তুমি গবেষণা করে বের কর।
হামিদ জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। ত্রিশটা গাঁদা ফুলের মালা এবং দুটা টাকার মালা গলায় পরিয়ে তাকে জেল গেট থেকে খোলা জিপে তোলা হলো। তিনি হাসিমুখে সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে লাগলেন। জিপ কিছুক্ষণ চলার পরই তিনি ভুলে গেলেন যে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন না-কি জেলে যাচ্ছেন। রব্বানি তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে। ইচ্ছা করলেই তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তা তিনি করলেন না। নেতার স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে শুনলে শিষ্যদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। তিনি আদুরে গলায় ডাকলেন, রব্বানি!
রব্বানি বলল, জি ওস্তাদ।
হামিদ বললেন, ওস্তাদ বলবা না রব্বানি! ওস্তাদ বললে নিজেকে ট্রাক ড্রাইভার ট্রাক ড্রাইভার লাগে। এখন থেকে যতবার রব্বানি বলব তারই জি নেতা! বলে সাড়া দিবে।
অবশ্যই।
রব্বানি।
জি নেতা।
হামিদ জনগণের উদ্দেশ্যে চলন্ত জিপ থেকে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, রাজনীতিতে সবসময় নতুন কিছু করতে হয়। যেই নতুন কিছু করবে পাবলিক খাবে। সামনের ডাস্টবিনে কাক কা কা করছে, দেখেছ?
জি নেতা।
কাকদের দেখে মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। সব নেতার কাঙালি ভোজন করান। আমি করাব কাক ভোজন। গরুর মাংসের তেহারি বানিয়ে সব ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে দিয়ে আসবে।
কবে করব?
আমার জন্মদিনে করবে। তবে আমার জন্মদিন কেউ জানে না। আমিও জানি। তোমরা বিবেচনা করে একটা তারিখ বের কর। আবার খেয়াল রেখ গুরুত্বপূর্ণ কোনো তারিখের সঙ্গে যেন ক্ল্যাশ না করে। বুঝতে পারছ?
পানির মতো পরিষ্কার। ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট এইসব তারিখ বাদ।
হামিদ ঘরে ফিরে দেখেন জার্কিন মুখ শুকনা করে বসে আছে। তিনি আনন্দে অভিভূত হলেন। হামিদ চিরকুমার মানুষ। জাবিন তার কাছে কন্যার চেয়েও বেশি। জাবিন কদমবুসি করতেই তার চোখে পানি এসে গেল।
জাবিন বলল, আপনার শরীরের এই অবস্থা কেন চাচা? গালটাল ভেঙে কি হয়েছে। চোখের নিচে কালি!
হামিদের মনে হলো তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের কেউ কোনোদিন বলে নি তাঁর শরীরের অবস্থা খারাপ। এই মেয়েটা বলছে। হামিদ বললেন, জনগণের সেবা করতে গিয়ে এই অবস্থা মা।
জাবিন বলল, অনেক জনগণের সেবা করেছেন। আর লাগবে না। আমি বাবার সঙ্গে আপনাকেও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাব। এখানে আপনার দেখাশোনার কেউ নেই। বাকি জীবন আমি আপনাদের দেখাশোনা করব।
হামিদের চোখে দ্বিতীয়বার পানি এসে গেল।
জাবিন বলল, আপনার জন্যে কিছু উপহার এনেছি, দেখুন পছন্দ হয় কি না। এটা ভেড়ার লোমের গায়ের চাদর। এটা মানিব্যাগ। সাধারণ মানিব্যাগ না। এর ভেতর ট্রেকিং ডিভাইস আছে। ধরুন মানিব্যাগ চুরি গেল, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে খুঁজে বের করা যাবে কোথায় আছে। একটা সোলার এনার্জি টর্চলাইট এনেছি। ব্যাটারি ছাড়া চলবে।
দুপুর তিনটা বাজে। জাবিন ফেরে নি। মাসুদ একাই খেতে বসেছে। রফিক যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। রফিকের রান্না ভালো।
দুলাভাই, আচার দিব? আচার দিয়া খাবেন?
মাসুদ বলল, দাও। বিদেশে থেকে আমার দিয়ে ভাত খাওয়া ভুলে গেছি। বিদেশ হচ্ছে সসের দেশ। সস কি কোনোদিন বাঙালি আচারের ধারেকাছে আসতে পারে?
মাসুদ তৃপ্তি করে আচার দিয়ে ভাত খেল। আচারটা অতিরিক্ত ঝাল, কিন্তু খেতে অসাধারণ। মাসুদ বলল, এটা কিসের আচাররে?
রফিক বলল, পিঁপড়ার আচার।
পিঁপড়ার আচার মানে?
রফিক বলল, করিম স্যার বানায়েছেন। এই আচারের নাম পিপিলিকা ক্রন্দন।
মাসুদ বলল, যেগুলিকে আমি রসুনের খোসা মনে করছি সেগুলি পিঁপড়া?
রফিক নির্বিকার ভঙিতে বলল, জি দুলাভাই। নজর কইরা দেখলেই বুঝবেন।
মাসুদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। রফিক বলল, বমি করবেন দুলাভাই? চিলুমচি আনি?
হামিদ জাবিনকে নিয়ে খেতে বসেছেন। তিনি বললেন, তোর বাবাকে পুলিশ খুঁজছে এটা কোনো বিষয়ই না। আগামীকালের মধ্যে রীট করে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে নিব। তাতেও সমস্যা হলে গোপনে আগরতলা পাচার করে দিব। আগরতলায় আমার নিজের কেনা বাড়ি আছে। লোকজন আছে। কোনো অসুবিধা হবে না। বৎসরের পর বৎসর থাকতে পারে। তোর বাবা করেছেটা কী? মার্ডার।