আইনুদ্দিন বললেন, রফিক ছেলেটা রান্নাবান্নায় বিশেষ পারদর্শী বলে মনে হচ্ছে না। প্রায়ই লবণ ছাড়া তরকারি রাধছে। তুমি আলাভোলা মানুষ বলে বুঝতে পারছ না। একদিন সকালে আমাকে চিনির বদলে লবণ দিয়ে চা দিল।
ওকে কিছু বলো না কেন?
লজ্জা পাবে বলে কিছু বলি না। মানুষ হয়ে জন্মেছে, ভুল তো করবেই।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে সানাউল্লাহ রাতে ঘুমুতে গেছেন। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে হমড়ু-ডমরুকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছেন।
ক্রমে ক্রমে রাজার ছেলেরা বড় হইয়া উঠিল। পেঁচা আর বানরও বড় হইল। পাঁচ রাজপুত্রের নাম হইল— হীরারাজপুত্র, মানিকরাজপুত্র, মোতিরাজপুত্র, শঙখরাজপুত্র আর কাঞ্চন রাজপুত্র।
পেঁচার নাম হইল ভুতুম
আর
বানরের নাম হইল বুদ্ধু।…
এই সময় জাৰিনের টেলিফোন। সে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, টেলিফোন করে করে তোমাকে পাচ্ছি না। বাবা, কী করছ?
সানাউল্লাহ বললেন, গল্প পড়ে শুনাচ্ছিরে মা। তোকে যেমন শুনাতাম। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে পড়ে শুনাচ্ছি।
কাকে পড়ে শোনাচ্ছি?
হমড়ু আর ডমরুকে।
জাবিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কাকে?
মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে সানাউল্লাহ বললেন, নিজেকেই পড়ে শোনাচ্ছি। আর কল্পনা করছি তুই ঘুমঘুম চোখে পাশে আছিস।
জাবিন বলল, অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তোমার সম্পর্কে শুনতে পাচ্ছি বাবা। মন অত্যন্ত খারাপ।
সানাউল্লাহ চিন্তিত গলায় বললেন, কী কথা শুনছিস?
জাবিন বলল, যারাই তোমার সঙ্গে মেশে তাদেরকেই তুমি পাগল বানিয়ে ছেড়ে দাও।
কাকে আবার পাগল বানালাম?
হামিদ মামাকে। উনি এখন রোজ সকালে নাশতার মতো একটা করে ব্যাটারি খান।
এটা তো জানতাম না।
আবু করিম চাচা তো মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একজন শুধু বাকি আছে। আইনুদ্দিন চাচা। বাবা, উনিও কি পাগল হয়ে গেছেন? ইন্টারনেটে দেখলাম তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কুবা চাচি তার সন্ধান চেয়ে সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আমাকে তো তুমি কিছুই জানাচ্ছ না।
সানাউল্লাহ বললেন, আইনুদ্দিন ভালো আছে। আমার বাড়িতেই লুকিয়ে w!
বলো কী! কেন?
জটিল একটা অংক ধরেছে। তার বাসায় অংকের পরিবেশ নেই।
কী অংক?
ভূতের একটা অংক। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দিয়ে ভূত আছে কি নাই প্রমাণ হয়ে যাবে। সে ভূতের wave function তৈরি করে ফেলেছে।
জাবিন কাদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা কী হচ্ছে।
সানাউল্লাহ বললেন, কিছু হচ্ছে না তো মা। সব নরমাল।
তুমি কি ভালো আছি?
সানাউল্লাহ বললেন, আমি খুবই ভালো আছি। এমনিতেই ভালো ছিলাম, কবিগুরুর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর আরো ভালো লাগছে।
কার সঙ্গে কথা বলেছ?
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরকালে বসে উনি এখন নিজের পুরনো কবিতা কারেকশন করছেন। ঐ যে কবিতাটা আছে না—
শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির
এখানে এক ফোঁটার জায়গায় এখন হবে দুফোঁটা। তোর কাছে সঞ্চয়িতা আছে না? কারেকশন করে ফেল।
জাবিন টেলিফোন রেখে দিল। ইন্টারনেট নিয়ে বসল। ঢাকায় আসার টিকিট কাটবে। আর দেরি করা যাচ্ছে না।
সানাউল্লাহর সামনে রূপবতী
সানাউল্লাহর সামনে রূপবতী কিন্তু বামনটাইপ খাটো এক মেয়ে বসে আছে। সে নিজে খাটো, তার হাত-পাও খাটো। মেয়েটার চোখ পিটপিট রোগ আছে। সে ক্রমাগত চোখ পিটপিট করে যাচ্ছে। মেয়েটার গা থেকে ফিনাইলের কঠিন গন্ধ আসছে। মেয়েটা হোপ ক্লিনিকের নার্স। নাম রেনুকা। সে আবু করিমের একটা চিঠি নিয়ে এসেছে।
সানাউল্লাহ বললেন, মা, তোমার নাম?
মেয়েটা বলল, আমার নাম দিয়ে কী করবেন? চিঠি নিয়ে এসেছি চিঠি পড়েন। পুনশ্চ লেখাটা আগে পড়েন।
সানাউল্লাহ বললেন, নামটা বলে, আলাপ পরিচয় হোক।
মেয়েটা বলল, আলাপ পরিচয়ের কিছু নাই। আমার নাম রেনুকা। চিঠির পুনশ্চটা শুরুতেই পড়বেন। প্লিজ।
সানাউল্লাহ বললেন, পুনশ্চ শুরুতে পড়ব কেন? আগে চিঠি পড়ব, তারপর পুনশ্চ?
মেয়েটা বলল, পুনশ্চ পড়ে আমাকে আমার টাকাটা দিয়ে দিন। আমি চলে যাই। মর্নিং শিফটে আমার ডিউটি আছে। আরেকটা কথা, আমাকে চেক দিলে হবে না। নগদ টাকা দিতে হবে। ঘরে এত টাকা না থাকলে কাউকে ব্যাংকে পাঠিয়ে আনান।
সানাউল্লাহ বললেন, স্থির হয়ে বসো তো মা। এত নড়াচড়া করবে না। পুরো চিঠিটা আমাকে শান্তিমতো পড়তে দাও। তোমাকে টাকা দেবার ব্যাপার থাকলে টাকা দেয়া হবে।
সানাউল্লাহ চিঠি পড়া শুরু করলেন।
প্রিয় সানাউল্লাহ,
আমি মহাবিপদে আছি। এরা আমাকে জেলখানায় আটকে ফেলেছে। কোনো কারণ ছাড়াই রোজ রাতে পেথিড্রিন ইনজেকশন দিচ্ছে। দিনে দিচ্ছে কড়া ঘুমের ওষুধ। আপত্তি করলেই বিছানার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রাখছে। আমি শায়লার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। সম্ভব হয় নি।
এই ক্লিনিকের ব্যবসাই হচ্ছে রোগীকে আধাপাগল বানিয়ে চিকিৎসার নামে দীর্ঘদিন আটকে রাখা। যত বেশিদিন রাখতে পারে তাদের ততই লাভ।
আমি মানছি অচিার নিয়ে আমার অবসেশন আছে। এই অবসেশনের অর্থ কি আমি ভায়োলেন্ট মানসিক রোগী? সানাউল্লাহ, তুমি আমাকে যেভাবেই পার নরক থেকে উদ্ধার করো।
ইতি
আবু করিম।
পুনশ্চ : যে মেয়েটি এই চিঠি তোমার হাতে দিবে তাকে দশ টাকা দিয়ে দিবে।
সানাউল্লাহ মানিব্যাগ খুলে দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলেন। রেনুকা হতভম্ব গলায় বলল, দশ হাজার টাকা দেবার কথা। দশ টাকা দিচ্ছেন কেন? আমি নিজে পড়েছি দশ হাজার টাকী লেখা ছিল।