কবে যেতে বলছেন?
দেরি করে লাভ কী! আজই চলে আসুন। আমি ধানমণ্ডিতে থাকি।
সানাউল্লাহ বললেন, ভাই, আজ তো যেতে পারব না। আজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে আনা হবে। চক্রের মাধ্যমে আনা হবে। নরুন্দ সাহেব ব্যবস্থা করছেন। উনি থিয়সফিস্ট বিখ্যাত মিডিয়াম।
চিফ ইঞ্জিনিয়ার ড্রয়ার থেকে তার একটা কার্ড বের করে দিতে দিতে বললেন, কার্ডটা রেখে দিন। ঠিকানা লেখা আছে। যে-কোনো সন্ধ্যায় টেলিফোন করে বাসায় চলে আসবেন। আমার ছেলেমেয়েরা আপনার ভূতের বাচ্চার গল্প শুনবে। রবীন্দ্রনাথের আত্মার সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্পও শুনবে।
নরুন্দ সাহেবের বাড়িতে ভৌতিক চক্র বসেছে। একটা গোল টেবিলের চারপাশে হাত ধরাধরি করে পাঁচজন বসা। সবার হাত টেবিলে রাখা। টেবিলের মাঝখানে একটা মোমবাতি জ্বলছে। এছাড়া ঘরে কোনো আলো নেই। নন্দের গলায় বেলিফুলের মালা। মোমবাতির নিচেও কিছু টাটকা বেলিফুল রাখা হয়েছে। বেলি ফুলের কোনো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের এক কোনায় ধূপ পোড়ানো হয়েছে। ঘরভর্তি ধুপের গন্ধ। নন্দ কথা বলা শুরু করলেন—
ভৌতিক চক্রে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। এখানে যারা আছেন, তারা একাধিকবার চক্রে বসেছেন। আজ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নতুন সদস্য জনাব সানাউল্লাহ। তিনি একজন বিশিষ্ট গ্রন্থকার। তার সঙ্গে কথাবার্তা থেকে কিছুক্ষণ আগে জেনেছি তিনি যে গ্রন্থটি রচনা করছেন তার নাম দিনের শেষে ভূতের দেশে। এই নামটি কবিগুরুর গান থেকে ধার করা। আজ আমরা কবিগুরুকে চক্রে আহ্বান করব।
আপনারা সবাই চোখ বন্ধ করে এক মনে বলবেন, গুরুদেব আসুন। আমরা আপনার প্রতীক্ষায়। কেউ হাত ছাড়বেন না। আমরা হাতে হাত ধরে গেলি করে বসেছি। এই কারণে একটি চৌম্বক আবেশের তৈরি হয়েছে। যখন আবেশ জোরালো হবে তখন চৌম্বক ঝড় পরকালে ধাক্কা দেবে। কবিগুরু আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে আসবেন।
সানাউল্লাহ আশ্চর্য হয়ে বললেন, উনাকে কি চোখের সামনে দেখব?
নরুন্দ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সানাউল্লাহর দিকে তাকালেন। নরুন্দের অ্যাসিসটেন্ট আসগর মিয়া নরুন্দের ডানদিকে বসেছেন। কাকলাসের মতো চেহারা। নাকের নিচে বিরাট গোঁফ। গোফটা এমন যে মনে হয় গাম দিয়ে লাগানো। কথা বললেই খুলে পড়ে যাবে। আসগর মিয়া বললেন, রবীন্দ্রনাথের আত্মা স্যারের উপর ভর করবে। তখন রবীন্দ্রনাথের হয়ে স্যরি কথা বলবেন। স্যারের উপর ভর করার একটাই কারণ— স্যারের মতো মিডিয়াম অতি দুর্লভ।
নরুন্দ বললেন, অতি উচ্চশ্রেণীর ভৌতিক চক্রে অবশ্যি চর্মচক্ষেও আত্মা দেখা যায়। আমার কয়েকবার সেই সৌভাগ্য হয়েছে। শেকসপিয়র সাহেবকে দেখেছি। তার সঙ্গে হ্যান্ডশেকও করেছি। সেই গল্প আরেকদিন করব। যাই হোক, আপনারা আহ্বান শুরু করুন। আত্মার অবির্ভাবের পর তাকে প্রশ্ন করতে পারেন। প্রশ্ন করবেন বিনয় এবং ভদ্রতার সঙ্গে। সবার চোখ বন্ধ। বলুন, গুরুদেব আসুন। আমরা আপনার প্রতীক্ষায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নরুন্দর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। মাথা পেন্ডুলামের মতো দুলতে লাগল। আসগর মিয়া বললেন, গুরুদেব চলে এসেছেন। সবাই বলুন, সুস্বাগতম।
সবাই বলল, সুস্বাগতম।
নরুন্দ চোখ মেলে সবার দিকে তাকালেন এবং খানিকটা মেয়েলি গলায় বললেন, তোমরা ভালো আছ? বলেই তাকালেন সানাউল্লাহর দিকে।
সানাউল্লাহ ভীত গলায় বললেন, স্যার আমি ভালো আছি। অন্যদের কথা বলতে পারছি না। আপনি কেমন আছেন?
নরুন্দ (অর্থাৎ কবিগুরু) বললেন, আমি অনিত্য। জগৎ অনিত্য। আমি এই অনিত্যের মাঝেই নিত্যের অনুসন্ধানে ব্যস্ত আছি।
এখনো কি কবিতা রচনা করেন?
আমি যেখানে বাস করি সেখানে কাগজও নেই কলমও নেই। তারপরেও মনে মনে কাব্য রচনা করি। অবসরে নিজের লেখা পুরনো কবিতাগুলি আবৃত্তি করি–
শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো, দুই ফোঁটা দিলেম শিশির।
সানাউল্লাহ বিঘ্নিত হয়ে বললেন, নিজের কবিতা ভুল করেছেন স্যার। দুই ফোঁটা শিশির হবে না স্যার। হবে একফোঁটা শিশির।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, মর্তে আমি একফোঁটা শিশিরের কথাই লিখেছিলাম। পরকালে এসে মনে হলো আমাকে এই কৃপণতা মানায় না। শিশির দুই ফোঁটা হওয়া উচিত। কাজেই কারেকশন করেছি।
কথা শেষ হবার আগেই নরুন্দ গো গো শব্দ করতে করতে ধড়াম করে টেবিলে পড়ে গেলেন। আসগর মিয়া বললেন, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। গুরুদেব চলে গেছেন। আজকের মতো চক্রের সমাপ্তি। সবাই যার যার বাড়িতে চলে যান। আমার স্যার অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাকে মেডিকেলে নিতে হতে পারে।
সানাউল্লাহ বন্ধুকে নিয়ে রাতের খাওয়া খেতে বসেছেন। আইনুদ্দিনকে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হচ্ছে। বেচারা অংক নিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন বুঝাই যাচ্ছে। চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে।
সানাউল্লাহ বললেন, অঙ্ক কোন পর্যায়ে আছে? আইনুদ্দিন বললেন, একটা wave function দাড় করিয়ে ফেলেছি।
তাহলে তো মনে হয় অনেকদূর চলে গেছ।
আইনুদ্দিন চিন্তিত গলায় বললেন, তা না। জিনিস আরো জটিল হচ্ছে।
সানাউল্লাহ বললেন, রুবা ভাবি অস্থির হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। তুমি যে আমার এখানে আছ তা জানাব?
ভুলেও না। এখানে আমি ভালো আছি। শুধু খাবারদাবারে মাঝে মধ্যে সামান্য সমস্যা হচ্ছে।
কী সমস্যা? তোমার কাজের ছেলে, ওর নাম যেন কী? রফিক।