হমডু-ডমরুকে আইনুদ্দিনের কথা বলেছেন। তারাও আড়াল থেকে দেখে এসেছে। তারা আইনুদ্দিনের নাম দিয়েছে অংক চাচু।
সানাউল্লাহ এখন নিয়ম করে তাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। যুক্তাক্ষর ছাড়া বাংলা শব্দ দুজনই পড়তে পারে! হমড়ু যোগ-বিয়োগ শিখে ফেলেছে। ডমরু মনে হচ্ছে অংকে একটু কাঁচা। লেখাপড়া সানাউল্লাহ খুব কায়দা করে শেখাচ্ছেন। রফিককেও সঙ্গে নিয়ে বসছেন। তিনজন একসঙ্গে শিখছে। কাজেই রফিক কিছু বুঝতে পারছে না। হমড়ু ডমরু রফিকের আশেপাশেই ঘুরঘুর করে কিন্তু রফিক তাদের দেখতে পায় না। অথচ তিনি নিজে স্পষ্ট দেখছেন। মাঝে মাঝে তার নিজের ক্ষীণ সন্দেহ হয়। হমডু ডমরু তাঁর মনের কল্পনা না তো? পরমুহূর্তেই এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেন। মনের কল্পনা হলে রোজ যে ব্যাটারি কিনে আনছেন, সেই ব্যাটারিগুলি খাচ্ছে কে?
হমড়ু ডমরুর ওপর তার অস্বাভাবিক মায়া পড়ে গেছে। এখন তারা আর খাটের নিচে ঘুমায় না। সানাউল্লাহর সঙ্গে খাটেই ঘুমায়। সানাউল্লাহকে রাতে গল্প শুনাতে হয়। সানাউল্লাহ ঠাকুরমার ঝুলি বইটা কিনে এনেছেন। রোজ রাতে বই থেকে দশ পাতা পড়ে শুনাতে হয়। তিনি চেষ্টা করছেন দুই ভাইবোনের রাতে জেগে থাকার অভ্যাস দূর করতে। মানুষের সঙ্গে তারা যেহেতু বাস করছে তাদের মানুষের স্বভাব গ্রহণ করাই ভালো। ডমরু এখন রাতে ঘুমানো অভ্যাস করে ফেলছে। হমডু ঘুমাচ্ছে না, তবে হাইতোলা শুরু করেছে। মনে হয় কিছুদিন পর সে নিজেও ঘুমাতে শুরু করবে।
সানাউল্লাহ ভূত সমাজের জন্যে কিছু করতে চান। প্রাণী হিসেবে মানুষের অবস্থান ভূতের ওপরে। ওপরের অবস্থানের প্রাণী দুর্বলদের জন্যে কিছু করবে সেটাই স্বাভাবিক। ভূতদের জন্যে তিনি কী করবেন তা মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছেন—
ক, বাসস্থান সমস্যার সমাধান। যেসব গাছে ভূতরা থাকতে চায় সেইসব গাছ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে লাগানো। যেমন, শ্যাওড়া গাছ, তেঁতুল গাছ, বেল গাছ, বাঁশঝাড়। অনাথ ভূতশিশু কিংবা পিতামাতা পরিত্যক্ত ভূত শিশুদের জন্যে একটা এতিমখানা প্রতিষ্ঠা।
খ. ভূতদের আদমশুমারি অর্থাৎ ভূত শুমারি করা। যাতে বাংলাদেশে ভূতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়।
গ. ভূত খাদ্য। ভূতরা ঠিকমতো খাদ্য খাচ্ছে কি-না সেটাও লক্ষ রাখতে হবে। খাদ্যের অভাবে এরা যেন কষ্ট না পায়।
ঘ. তাদের শিক্ষার দিকটাও দেখতে হবে। মানুষরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এতদূর এগিয়েছে, ভূতরা শিক্ষার অভাবে পিছিয়ে থাকবে, এটা কেমন কথা!
সানাউল্লাহ একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। যেসব ভূত ঢাকা শহরে বাস করে, তাদের নগরের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার আছে। এই বিষয়টাই উনাকে বুঝিয়ে বলা।
চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ঢাকা শহরে আপনি শ্যাওড়া গাছ আর বাশ গাছ লাগাতে চান?
সানাউল্লাহ বললেন, জি জনাব। নিজ খরচে করব, এতে বাসস্থান সমস্যার আশু সমাধান হবে।
কার বাসস্থান?
ভূতদের বাসস্থান। তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তো হবে না। ওদের সুযোগ-সুবিধা আমাদের দেখতে হবে। তারা আমাদের মতোই ঢাকা শহরে বাস করছে। যদিও মিউনিসিপ্যালটি Tax দিচ্ছে না। প্রয়োজনে দিবে।
আপনি কি সত্যি সত্যি ভূতদের জন্যে শ্যাওড়া গাছ লাগাতে চাচ্ছেন?
জি জনাব। আমি পুরো বিষয়টা ব্যাখ্যা করে মেয়র সাহেবের কাছে একটা আর্জিনামা লিখে এনেছি।
আর্জিনামা রেখে যান, আমি মেয়র সাহেবের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব।
সানাউল্লাহ বললেন, আপনার অশেষ মেহেরবানি। ভূত সমাজের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাচ্ছি আমার কৃতজ্ঞতা।
চিফ ইঞ্জিনিয়ার বললেন, ভাই যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কিন্তু ভালো চিকিৎসা দরকার।
সানাউল্লাহ বললেন, আমার মেয়ে জাবিনেরও তাই ধারণা। সে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসা নেব। মেয়ে দেখবে।
মেয়ের কাছে থাকুন, ভালো থাকবেন। ভূতদের নিয়ে ভূতরা চিন্তা করুক। তাই না? আরেকটা কথা, ভূতদের প্রতি আপনার এত মমতা, আপনি নিজে কি কখনো ভূত দেখেছেন?
সানাউল্লাহ বললেন, ভূতের দুই বাচ্চা আমার সঙ্গেই থাকে। এরা ভাইবোন। বোনটা আমাকে বাবা ডাকে। এই তথ্যটা আপনাকে প্রথম জানালাম। আর কেউ জানে না। আমার মেয়ে জাবিনকেও বলি নি। একটা ভূতের বাচ্চা আমাকে বাবা ডাকছে— এটা জানলে সে মনে কষ্ট পেতে পারে।
চা খাবেন?
সানাউল্লাহ বললেন, চা খাব না ভাই। আপনি যে চা খাওয়াতে চেয়েছেন এটাই যথেষ্ট। অফিস-আদালতে এই কাজটা আজকাল কেউ করে না। সবাই আছে নিজের ধান্ধায়। সবাই দেখছে নিজের স্বার্থ। আমার মেয়ে আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। সে দেখছে নিজের স্বার্থ। সে একবারও চিন্তা করছে না ভূতের বাচ্চা দুটার কী হবে? এদের কার কাছে রেখে যাব?
চিফ ইঞ্জিনিয়ার বললেন, এদের আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। ভূতের দুই বাচ্চার ভিসাও লাগবে না। টিকিটও লাগবে না।
সানাউল্লাহ আনন্দিত গলায় বললেন, অতি উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন ভাই সাহেব। আমার মাথায় বিষয়টা একবারও আসে নি। আপনার এখানে আসা আমার সার্থক হয়েছে।
যদি সময় পান অষ্ট্রেলিয়া যাবার আগে একবার আসবেন।
অবশ্যই আসব।
সবচেয়ে ভালো হয় আমার বাসায় যদি একবার আসেন। আপনার নিজের মুখ থেকে পোষা ভূতের গল্প শুনলে আমার ছেলেমেয়েরা মজা পাবে। ওরা আমার কাছে রোজ রাতে ভূতের গল্প শুনতে চায়। আমি কোনো ভূতের গল্প জানি না বলে বলতে পারি না।