মা রেখে গেছে।
সানাউল্লাহ বললেন, তোর মা গেছে কই?
বাবার খোঁজে গেছে। বাবা রাগ করে দেশান্তরী হয়েছে। মা গেছে তাকে খুঁজে আনতে। মা আমাদের বলেছে, তোরা ঐ বাড়িতে থাক। উনি লোক ভালো।
আমার কথা বলল?
হুঁ।
আমাকে চিনল কীভাবে?
আমরা তো আপনার বাসার সামনের কাঁঠাল গাছে থাকতাম। মনে নাই। একদিন পা পিছলে কাঁঠাল গাছের সামনে ধুম করে পড়ে গেলেন। পা কেটে গেল। ঐদিন বাবা আপনাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল। আমার বাবা একটু দুষ্টু আছে।
তোর বাবা-মার ঝগড়া কী নিয়ে?
বাবা দুষ্টু যে এই নিয়ে ঝগড়া। মা বলতো, যার আশ্রয়ে থাক তাকে যখন তখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও এটা কেমন কথা!
শেষে বাবা রাগ করে বলল, যা দেশান্তরী হব।
তোরা অপেক্ষা কর। দেখি মধু পাই কি-না। এত রাতে দোকান তো সব বন্ধ।
হম বলল, ওষুধের দোকান সারারাত খোলা থাকে। ওষুধের দোকানে মধু পাবেন।
সানাউল্লাহ ভূত ছেলের বুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হলেন। ওষুধের দোকানে মধু পাওয়া যায় এটা তার মাথাতেই আসে নি।
তিনি মধু কিনলেন। বাসায় ফিরে মধুর কৌটা খাটের নিচে রেখে চিন্তিত হয়েই ঘুমুতে গেলেন। খাটের নিচে কাউকে দেখা গেল না। সানাউল্লাহ নিশ্চিত, একটু আগে যা দেখেছেন সবই চোখের ভুল। একটা বয়সের পর মানুষ ভুলভাল দেখা শুরু করে। মনে হয় তার সেই বয়স হয়েছে। তিনি কান খাড়া করলেন। খাটের নিচে চকচক শব্দ হচ্ছে। চেটে মধু খাবার শব্দ। তাঁর নিজের খাটের নিচে দুটা ভূতের বাচ্চা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, আবার মধু খাবার চকচক শব্দও অবিশ্বাস করা যাচ্ছে না।
সানাউল্লাহর ঘুম যখন আসি আসি করছে তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে তাঁর মেয়ে জাবিন টেলিফোন করল।
বাবা! কয়েকবার তোমাকে টেলিফোন করেছি, তুমি টেলিফোন ধরো নি।
সানাউল্লাহ বললেন, মধু কিনতে গিয়েছিলামরে মা। ভুলে মোবাইল ফেলে গিয়েছিলাম।
তোমার ডায়াবেটিস, তুমি মধু কিনবে কেন?
নিজের জন্যে না-রে মা। ডমরুর জন্যে। সে মধু ছাড়া কিছুই খায় না।
ডমরু কে?
ডমরু হলো হমডুর ছোটবোন।
এরা কারা?
সানাউল্লাহ বললেন, এদের আলাপটা আজকে থাকুক। আরেকদিন করি।
জাবিন বলল, আরেকদিন করতে হবে কেন? আজই কর। এরা কে?
হমড়ু ডমরুর মা কয়েকদিনের জন্যে আমার এখানে এদের রেখে গেছে। পরে নিয়ে যাবে।
বিড়ালের বাচ্চা?
প্রায় সেরকমই।
প্রায় সেরকম বলছ কেন? ঠিক করে বলো তো।
সানাউল্লাহ অস্বস্তির সঙ্গে আমতা আমতা করতে করতে বললেন, ভুতের বাচ্চা।
ভূতের বাচ্চা?
হুঁ।
তুমি ভূতের বাচ্চার জন্যে মধু কিনতে গিয়েছিলে?
হুঁ। মা রাখি, পরে কথা হবে।
না, টেলিফোন রাখবে না। এখনই শুনব। ভূতের বাচ্চা দুটা এই মুহূর্তে কোথায়?
আমার খাটের নিচে আছে।
তুমি ওদের দেখতে পাচ্ছ?
ভাইটাকে দেখতে পাই। বোনটা ছোট, দেখতে পাচ্ছি না। বেচারীর আবার জ্বরও এসেছে।
জাবিন থমথমে গলায় বলল, তুমি কি আজ ঘুমের ওষুধ খেয়েছ?
না।
শোবার আগে একটা ঘুমের ওষুধ খাবার কথা না?
হ্যাঁ।
অজি দুটা ট্যাবলেট খেয়ে আরাম করে ঘুমাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডাক্তারের কাছে যাবে। থরো চেকআপ করবে। তোমার ঘরে ভূতের বাচ্চা, এই কথাও অবশ্যি ডাক্তারকে জানাবে। মনে থাকবে বাবা?
হ্যাঁ মনে থাকবে।
আমি কাল রাতে আবার টেলিফোন করব। বৰা, গুড নাইট।
গুড নাইট মা।
সানাউল্লাহ মেয়ের কথা মতো দুটা ঘুমের ট্যাবলেট (হিপনল, দশ মিলিগ্রাম) খেলেন। একগ্লাস পানি খেলেন। ঘুমের ওষুধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যেতে নেই। পনেরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। তিনি ফ্রিজ থেকে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে বিছানায় বসলেন। চুকচুক করে পানি খাবেন। ঝিমুনি আসার জন্যে অপেক্ষা করবেন। এই ফাঁকে মড়ুর সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করা যায়। তবে হড়ু মরুর বিষয়টা পুরোপুরি তার মাথার কল্পনাও হতে পারে। তার আপন ফুপা ফজলু চোখের সামনে কালো রঙের একটা কুকুর দেখতেন। কুকুরটী অন্ধ। তার লেজটা না-কি কাটা। কুকুর দেখামাত্র তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়তেন। বিকট চিৎকার করতেন, আসছে! আবার আসছে! আমার হাতে একটা লাঠি দে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুও হয় কুকুরের ভয়ে। কুকুরটা নাকি তার গলা কামড়ে ধরেছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ছাড়াতে পারেন নি। গোঁ গোঁ করতে করতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু।
সানাউল্লাহ পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ডাকলেন, হমডু!
হমড়ু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, হুঁ।
সানাউল্লাহ বললেন, হুঁ কিরে ব্যাটা? বল জি। ভূতের বাচ্চা বলে আদবকায়দা জানবি না? তোর বোনের জ্বর কমেছে?
না। জ্বর আছে।
মধু খেয়েছে?
হুঁ।
ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে জ্বর আবার আসতে পারে। একটা চাদর দেই। চাদরে ঘুমাও।
না।
তোদের ঘুমের ব্যাপারটা কী রকম? তোরাও কি আমাদের মতো রাতে ঘুমাস?
আমরা দিনে ঘুমাই। রাতে জেগে থাকি।
মানুষরা যেমন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখে তোরা দেখিস?
হঠাৎ হঠাৎ দেখি।
কী রকম স্বপ্ন? ভয়ের না আনন্দের?
ভয়ের।
সানাউল্লাহ বললেন, মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে বদহজম থেকে। খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম হলেই দুঃস্বপ্ন। আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছেন— আবু করিম। উনি বলেছেন। বড় ডাক্তার। কাল যাব তার কাছে। দেখি তোর বোনের জ্বরের জন্যে কোনো ওষুধ আনা যায় কি-না।
হমড়ু বলল, কে টেলিফোন করেছিল?
সানাউল্লাহ বললেন, আমার মেয়ে জাবিন।
আপনার একটাই মেয়ে?
হুঁ। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।