আইনুদ্দিনের স্ত্রী এবং শাশুড়ি আজ এই উদ্দেশ্যেই সন্ধ্যা থেকে বসে আছেন। বেড়াতে যাবার কথা বলে আইনুদ্দিনকে গাড়িতে তোলা হবে। আইনুদ্দিন রাজি হয়েছেন। তিনি বলেছেন একটা জটিল অঙ্ক করছেন। অঙ্ক শেষ হলেই গাড়িতে
সালেহা বেগম বললেন, বাবা, এটা কী অঙ্ক এত সময় লাগছে।
আইনুদ্দিন বললেন, ভূত বিষয়ক একটা অঙ্ক।
ভূতের অঙ্ক?
জি। বিষয়টা হচ্ছে–আমি ভূতের একটা কাল্পনিক সমীকরণ দাঁড় করিয়েছি।
ভূত কণার কৌণিক ভরবেগ হিসাবে Fermion কণা নিয়েছি। তবে তার সঙ্গে একটি ইমাজিনারি নাম্বার বসিয়ে দিয়েছিঅর্থাৎ স্কয়ার রুট অব মাইনাস ওয়ান। যেহেতু ভূত একটি ইমাজিনারি বিষয়, ইমাজিনারি নাম্বারটা আসা উচিত।
সালেহা বেগম মেয়ের সঙ্গে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। রুবা বলল, তোমার এই ভূতের অঙ্ক শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে?
আইনুদ্দিন বললেন, বুঝতে পারছি না।
রুবা বলল, এক ঘণ্টার জন্যে অংকটা বন্ধ রাখ। আমরা এর মধ্যে ঘুরে চলে আসব।
আইনুদ্দিন বললেন, কোথায় যাব?
সালেহা বেগম বললেন, একটু আগে কী বললাম? আমার এক পরিচিত রোগী হোপ ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে। তাকে দেখে আসব।
আইনুদ্দিন বললেন, আমি তাকে জবেকীকরব। আমি তো ডাক্তার না।
রুবা বলল, কেউঅসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া হলো সামাজিক। তুমি রাজি হয়েছিলে যাবে, এখন গাঁই গুই করছ কেন?
অঙ্ক করছি তো।
তোমার অঙ্ক পালিয়ে যাচ্ছে না। একঘণ্টার মধ্যে আবার শুরু করতে পারবে।
আইনুদ্দিন বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।
সালেহা বেগম বললেন, বরং একটা কাজ কর, তোমার খাতা কলম সাথে নিয়ে দাওন। গাড়িতে যেতে যেতে ভূতের অঙ্ক করবে। এই বলেই তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলেন।
অইনুদ্দিন খাতা এবং কলম নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তখন তাঁর হঠাৎ করে মনে হলো—প্রকৃতি জটিলতা পছন্দ করে না। তিনি অকারণেই সমীকরণ জটিল করেছেন। ভূতের কণা হওয়া উচিত Boson কণা। নতুন এই বিষয় মাথায় নিয়ে হাসপাতালে যাবার প্রশ্নই ওঠে। তিনি বলেন, একটা মিনিট সময় চাই বাথরুমে যাব।
সালেহা বেগম দরাজ গলায় বললেন, এক মিনিট কেন? যতক্ষণ লাগে সময় নাও। ভালোমতো হাতমুখ ধুয়ে নিও। ভূতের ভঙ্ক করতে করতে তোমাকে দেখাচ্ছেও ভূতের মতো।
আইনুদ্দিন বাথরুমে না ঢুকে পেছন দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। তাঁর গন্তব্য সানাউল্লাহর বাড়ি। তিনি ঠিক করেছেন অঙ্ক শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকবেন।
সালেহা বেগম হেপি ক্লিনিকে জোহরা খানমকে টেলিফোন করে জানালেন, রোগী নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হচ্ছি। রোগী এখন বাথরুমে। বাথরুম থেকে বের হলেই রওনা হবো। গাড়ি রেডি আছে। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। এখন সে ভূতের অঙ্ক করছে।
জোহরা খানম বললেন, কোনোরকমে ক্লিনিকে নিয়ে আসুন। ভূতের অঙ্ক চিরজীবনের মতো ভুলিয়ে দেব।
রাত এগারোটায় আইনুদ্দিন অনেক ঝামেলা করে সানাউল্লাহর বাড়ি খুঁজে পেলেন। আইনুদ্দিনের চেহারা উদ্ভ্রান্ত। তিনি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন সানাউল্লাহর বাড়ি খুঁজে পাবেন না। বাকি জীবন তাঁকে রিকশায় বসে কাটাতে হবে। এটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে রিকশা ভাড়া। তিনি শূন্য পকেটে বের হয়েছেন।
তিনদিন হলো আইনুদ্দিন মহানন্দে
তিনদিন হলো আইনুদ্দিন মহানন্দে সানাউল্লাহর বাড়িতে বাস করছেন। তাঁকে আলাদা একটা ঘর দেয়া হয়েছে। চেয়ার-টেবিল দেয়া হয়েছে। নীলক্ষেত থেকে বিশাল সাইজের কোলবালিশ কিনে আনা হয়েছে। দিনের মধ্যে কয়েকবার কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকা তার অভ্যাস। আইনুদ্দিনের রুটিন এরকম—
সকাল ছটা : ঘুম থেকে জেগে উঠেন। এক কাপ লিকার চা খেয়ে এবং Physics in trouble বইটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকেন। সকাল সাতটা; নাশতা খেয়েই লেখার টেবিলে। অংক কষার শুরু।
সকাল দশটা। : অংকে বিরতি। কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকা।
সকাল এগারোটা : আবার অংক শুরু।
দুপুর একটা : লাঞ্চ শেষ করে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুম।
দুপুর তিনটা : কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকা।
সন্ধ্যা ছটা : অংক শুরু।
রাত এগারোটা : রাতের খাবার এবং এক ঘুমে রাত কাবার।
সানাউল্লাহর সঙ্গে তার কথাবার্তা হয় না বললেই ঠিক বলা হয়। রফিক এই মানুষটাকে দেখে মুগ্ধ। সে এসে সানাউল্লাহকে বলল, বিরাট পাগল আদমি স্যার।
সানাউল্লাহ বললেন, কী করে বুঝলি পাগল আদমি?
রফিক বলল, প্রথম রাইতেই বলেছি স্যার আমার নাম রফিক। কিছু যদি লাগে রফিক বইল্যা আওয়াজ দিলে দুইটা আসব। সকালবেলা জিগ্যাস করে— এই তোমার নাম কী? নাম বললাম। সইন্ধ্যাবেলা আবার জিগায়, এই তোমার নাম কী? দিনের মধ্যে কয়েকবার উনারে নাম বলতে হয়।
সানাউল্লাহ বললেন, অতিরিক্ত জ্ঞানের মানুষ তো, এইজন্যে এরকম।
রফিক বলল, খাওয়া খাদ্য নিয়াও উনার কোনো চিন্তা নাই। যা দিতেছি খাইয়া ফেলতেছে। লবণ ছাড়া একবার তরকারি রাইন্ধা দিলাম। আপনেরে আলাদা লবণ দিয়া দিছি। উনারে লবণের একটা দানাও দেই নাই। খাইয়া ফেলছে। কিছু বুঝে নাই।
এরকম আর করবি না। যত্ন করবি।
অবশ্যই যত্ন করব স্যার। জ্ঞানী মানুষের যত্ন না করলে কার যত্ন করব? মূখের যত্ন? বাপ-মা আমারে এইজন্যে পয়দা করে নাই।
সানাউল্লাহ ভেবেছিলেন হমডু-ডমরুর সঙ্গে আইনুদ্দিনের পরিচয় করিয়ে দেবেন। শেষে পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন। ভূতের বাচ্চা দেখে মানুষটা ঘাবড়ে যেতে পারে। জটিল অংক নিয়ে বসেছে। শেষে অংকে গণ্ডগোল হয়ে যাবে।