কাদের খান বললেন, বলে ভালো করেছেন স্যার। আমি একটু টানাটানির মধ্যে আছি। সানাউল্লাহ স্যার বসবেন। এইসব বিষয় উনারই বেশি জানা দরকার।
নরুন্দ ভূত-পরকাল বিষয়ে যা বললেন তা হচ্ছে— আত্মা বা soul অবিনশ্বর। আত্মারাই ঘুরাফেরা করেন। তাদেরকে আমরা ভূত বলে ভুল করি। ভূত হচ্ছে পরকালের জীবজন্তু। এদের জন্ম-মৃত্যু আছে।
সানাউল্লাহ বললেন, আমরা যেমন মৃত্যুর পর পরকালে যাচ্ছি। ভূতরা কোথায় যায়?
নরুন্দ বললেন, ওদের জন্যে আলাদা পরকাল আছে। সেই পরকাল হচ্ছে শুদ্ধতা শিক্ষার আবাস। সেখানে তারা শুদ্ধ হয়। শুদ্ধ হবার পর তারা মানুষ টাইটেল পায়। পুরোপুরি মানুষ হওয়া অবশ্যি তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা হয় ভূ-মানুষ। অর্থাৎ ভূত মানুষ। তাদের একজনকে আমি চক্রে আহ্বান করেছিলাম। অত্যন্ত ফ্রাস্টেটেড তার কথাবার্তা।
কাদের খান বললেন, স্যার, একটু পরিষ্কার করে যদি বলেন। কিছুই বুঝতে পারছি না।
নন্দ বললেন, পাঁচ মিনিট কথা বলেই সব বুঝে ফেলতে চান? তা-কি হয়? আমি বৎসরের পর বৎসর এই বিষয় নিয়ে কাজ করে সামান্য একটা নুড়ি কুড়িয়ে পেয়েছি।
সানাউল্লাহ বললেন, স্যার, বিদায় দেন। যাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি।
নরুন্দ বললেন, আমার আধাঘণ্টা সময় নিয়েছেন। তার ফি বাবদ দুজনের পাঁচশ টাকা হয়। আপনারা চারশ টাকা দিন। আপনাদের জন্যে স্পেশাল ডিসকাউন্ট দিলাম। ভূত নিয়ে বই লিখছেন বলেই এই ডিসকাউন্ট।
সানাউল্লাহ পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, স্যার, পুরোটাই রেখে দিন।
নরুন্দ টাকা পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, আপনি আগামী বুধবার চলে আসুন। চক্রে বসিয়ে দেব। ঐদিন কবিগুরুকে ডাকব। প্রয়োজনে তাঁর কাছ থেকে একটা নামও নিতে পারেন।
কাদের খান রাস্তায় নেমেই বলল, বিরাট ফ্ৰড়। কী বলেন স্যার?
সানাউল্লাহ বললেন, চট করে কাউকে ফ্রড বলা ঠিক না। ভেতরে জিনিস আছে, আমরা বুঝতে পারছি না। আলোর গতি নিয়ে উনি যে কথাটা বললেন, তা শুদ্ধ জ্ঞানের কথা। চক্রে এসে দেখি কী হয়।
দুই হাজার টাকা খামাখা নষ্ট করবেন?
সানাউল্লাহ বললেন, নষ্ট নাও তো হতে পারে। সবকিছু নিগেটিভ ভাবে চিন্তা করা ঠিক না।
রাত বেশি হয় নি। আটটা বাজে। সানাউল্লাহ কাদের খানকে নিয়ে Hope ক্লিনিকে গেলেন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। সানাউল্লাহর অস্থির লাগছে। এর আগেও তিনি দুবার Hope ক্লিনিকে এসেছেন। দেখা হয় নি। আজ আরেকবার চেষ্টা নেবেন। রোগীর সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারবে না— এটা কেমন কথা! বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলে বরং রোগীর মন প্রফুল্ল হবে।
আজও দেখা হলো না। রিসিপশনে বসে অবিকল চামচিকার মতো মেয়েটি বলল, পেশেন্ট ঘুমাচ্ছে।
সানাউল্লাহ বললেন, মাত্র আটটা বাজে, এর মধ্যে পেশেন্ট ঘুমাচ্ছে?
রিসিপশনিস্ট বলল, আমাদের এখানকার নিয়ম হচ্ছে সন্ধ্যা সাতটায় ডিনার দেয়া হয়। সাড়ে সাতটার মধ্যে পেশেন্টকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়। মেন্টাল পেশেন্টের জন্যে ঘুমটাই একমাত্র চিকিৎসা।
কাদের খান বলল, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন না ম্যাডাম। হয়তো জেগে আছেন।
রিসিপশনেস্ট বলল, প্রথম কথা পেশেন্ট ঘুমুচ্ছে। দ্বিতীয় কথা জেগে থাকলেও দেখা করতে দেয়া হবে না। আমরা পেশেন্টকে solation-এ রাখি। উনাকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেই দেখা করতে দেয়া হয় না। আপনারা তো অনেক দূরের।
সানাউল্লাহ বললেন, আমি দূরের কেউ না। আমি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
পাগলের আবার বন্ধু কী? পাগলের কাছে সবাই বন্ধু আবার সবাই শত্রু, বুঝেছেন? এখন বিদায় হোন।
আবু করিম জেগে আছেন। এখন তিনি বাঁধা অবস্থায় নেই। বিছানায় পা ঝুলিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছেন। ঘুমের ইনজেকশন নিয়ে নিয়ে তার মধ্যে জবুথবু ভাব চলে এসেছে। তিনি হতাশ চোখে নার্সের দিকে তাকিয়ে আছেন। নার্স সিরিঞ্জে ওষুধ ভরছে।
আবু করিম বললেন, ইনজেকশনটা দুটা মিনিট পরে দাও। দুটা মিনিট তোমার সঙ্গে কথা বলি।
নার্স বলল, দুই মিনিট প্রেম করতে চান?
আবু করিম বললেন, প্রথম দিনেই তোমাকে মা বলে ডেকেছিলাম। তুমি মনে হয় ভুলে গেছ।
মার্স বলল, দুই মিনিট সময় দেয়া যাবে না। এক মিনিট দিলাম। বলুন কী বলবেন?
আবু করিম বললেন, আমি আমার বন্ধু সানাউল্লাহকে একটা চিঠি লিখেছি। চিঠিতে পুনশ্চ দিয়ে লিখেছি— যে তোমাকে এই চিঠিটা দেবে তুমি সঙ্গে সঙ্গে নগদ দশ হাজার টাকা দেবে। আমার বন্ধু টাকাটা অবশ্যই দেবে। এখন মা বলো, তুমি কি চিঠিটা তাকে পৌঁছে দিয়ে দশ হাজার টাকা রোজগার করতে চাও? আমার বালিশের নিচে চিঠিটা আছে।
নার্স বলল, আপনার এক মিনিট শেষ। হাত বাড়ান, ইনজেকশন দেব।
হতাশ আবু করিম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাত বাড়ালেন।
আইনুদ্দিনকে Hope ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা গোপনে গোপনে করা হয়েছে। আইনুদ্দিনের শাশুড়ি মেয়ে রুবাকে নিয়ে কাজটা করেছেন। ডা. জোহরা খানম ফিজিক্সের ছাত্রী সেজে গোপনে দেখেও গেছেন। তিনি বলেছেন, পেশেন্টের কথাবার্তা আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও পেশেন্ট সিঙ্গেল ট্রেক হয়ে গেছে। যে-কোনো মুহূর্তে ট্রেকচ্যুত হবে। তখনি ভায়োলেন্ট হয়ে যাবে। ট্রেকচ্যুত হবার আগেই তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা দরকার। আপনারা ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোনো রকমে তাঁকে ক্লিনিকের গেট পর্যন্ত আনুন। বাকিটা আমার লোকজন করবে।